মনে মনে দাউদ খুব উৎফুল্ল। শিকার তার হাতের নাগালে। হারেস ও তার পিতাকে তার স্বরূপ জানাতে দ্বিধা করছিল সে। গোয়েন্দা কখনো আবেগের কাছে হার মানতে পারে না এবং নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে দাউদ নিজের স্বরূপ প্রকাশ না করে কিছুই করতে পারছিল না। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, সাইফুদ্দীন যেখানে যাবে সেও তার অনুগামী হবে এবং সে সাইফুদ্দীনের সকল তৎপরতা প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু হারেসের ঘরে তার দীর্ঘদিন অবস্থান অসুবিধাজনক মনে হচ্ছিল না। এইজন্য প্রয়োজন ছিল তার স্বরূপ হারেস পরিবারের কাছে প্রকাশ করে দেয়া। বস্তুত তাদেরকে সম্পূর্ণ আস্থায় নিয়েই সে গোয়েন্দাসুলভ কৌশলে তাদের সাথে কথা বলা শুরু করে দিল। সে দেখল, সাইফুদ্দীনকে হত্যার জন্য হারেস অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছে। তার পিতাও আইয়ূবীর দুশমনদের ঘৃণার চোখে দেখে, প্রচণ্ড অবজ্ঞা করে।
যদি আমি তোমাকে এরকম কৌশলের কথা বলি যদ্বারা সাইফুদ্দীন আর কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না, তাহলে কি আমার কথা মানবে? হারেসকে জিজ্ঞেস করল দাউদ।
আমার ছেলের মত তুমি যদি আবেগে উত্তেজিত হয়ে না থাক, তবে আমি তোমার সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। বলল হারেসের পিতা।
আমি ওকে হত্যা করা ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে পারি না। বলল হারেস।
তুমি যদি তোমার বিবেক ও আবেগের লাগাম আমার হাতে দিয়ে দাও, তাহলে তোমার দ্বারা আমি এমন কাজ করাব যা তোমার হৃদয়কে শান্তি এবং মনকে করবে স্থির। দাউদ গভীরভাবে পিতা-পুত্রকে নিরীক্ষা করল। অদূরেই বসে ছিল হারেসের স্ত্রী ও বোন। তারাও শুনছিল তাদের কথাবার্তা। দাউদ তাদের দিকে লক্ষ্য করে বলল, আমাকে একটি কুরআন শরীফ দিন। হারেসের বোন উঠে একটি কুরআন শরীফ চোখে লাগাল, চুমু দিল এবং বুকে স্পর্শ করে দাউদের কাছে এনে দিল। দাউদও কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে স্পর্শ করে চুমু দিল এবং চোখে লাগাল। সে কুরআন শরীফ খুলে পড়তে লাগল, শয়তান তাদেরকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে, আল্লাহর স্মরণ তাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে, এরা শয়তানের দল। জেনে রেখ, শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এরা লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়। আয়াতটি ছিল সূরা হাশরের ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াত। দাউদ কুরআন শরীফ খুলতেই কাকতালীয়ভাবে এ আয়াতটি তার চোখে আটকে গেল। তেলাওয়াতের পর বলল, এটি আল্লাহর পবিত্র কালাম। আমি এটিকে খুঁজে বের করিনি। আকস্মিকভাবে এই আয়াতগুলোই আমার চোখে ভেসে উঠেছে। এখানে রয়েছে আল্লাহ্ পাকের সতর্ক বাণী ও সুসংবাদ। কুরআন পরিষ্কার বলে দিয়েছে, যারা শয়তানের দলভুক্ত হবে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে, যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ধ্বংস ও পদদলিত হবে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা অপমানিত ও লজ্জিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের ধ্বংসের ব্যবস্থা না করতে পারি। এটা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। শয়তানের দলভুক্তদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনার ব্যবস্থা করা।
সে দুহাতে কুরআন মেলে ধরে সবার উদ্দেশে বলল, সবাই নিজেদের ডান হাত আল্লাহর পবিত্র কালামের উপর রাখ এবং প্রতিজ্ঞা কর এই রহস্য কখনো ভেদ করবে না এবং শত্রুকে পরাজিত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে।
ঘরের সবাই কুরআন শরীফের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল, তারা কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। কুরআন শরীফের মর্যাদা ও মহিমান্বিত প্রভাবে সারা ঘরের মধ্যে পিনপতন নিরবতা নেমে এল। ভারি হয়ে এল সবার নিঃশ্বাস। অপার বিস্ময়ে সবাই তাকিয়ে রইলো দাউদের দিকে।
তোমরা সবাই কুরআন শরীফের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছ, বলল দাউদ। আল্লাহ তাআলা তোমাদের মাতৃভাষায় কুরআন নাযিল করেছেন, কুরআনের প্রতিটি শব্দের অর্থ তোমরা জান এবং বোঝ। তোমরা যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কর এর শাস্তি কুরআনে কি তাও তোমরা জান। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তোমাদেরও পরিণতি হবে শয়তানের দোসরদের মত।
তুমি কে বাবা? এসব কি বলছ! বিচলিত কণ্ঠে দাউদকে জিজ্ঞেস করল হারেসের পিতা। মনে তো হয় তুমি অনেক বড় আলেম অথবা কোন কামেল ব্যক্তির মুরিদ।
না, আমি তেমন কোন আলেম নই। তবে আলেমদের নির্দেশিত পথেই আমি চলি। আমি কুরআনের নির্দেশে জীবন বাজি রেখে এখানে এসেছি। আমি এ শিক্ষা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কাছ থেকে পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমি মৌসুলের বাসিন্দা নই, দামেস্কের অধিবাসী। আমি কোন যাযাবর নই। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর একজন। এটাই হল সেই রহস্য যা প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতি তোমাদের কাছ থেকে নিয়েছি। তোমাদের সকলের সহযোগিতা আমার দরকার। আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দাও; আমি যা বলব তাই তোমরা করবে।
আমরা তো প্রতিজ্ঞা করেই বসেছি, তোমার যা বলার তা বলবে তো। বলল বৃদ্ধ।
আমার লক্ষ্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টি, বলল দাউদ। আমি যার হৃদয়ের কূট-কৌশল, চক্রান্ত বের করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কাছে পৌঁছাতে চাই, সেই ব্যক্তি ছাদের নিচেই ঘুমিয়ে আছে। আল্লাহ্ তাআলা আমাকে এখানে পৌঁছাতে অলৌকিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমাকে জানতে হবে সাইফুদ্দীন ও তার সহযোগিরা কি করতে চায়, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? যদি এরা পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তাহলে এদের যুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালীন সময়ে অথবা এর আগেই সব অপতৎপরতা ভণ্ডুল করে দিতে হবে। তাদের পরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নের আগেই আমাদের জানতে হবে। এমনও তো হতে পারে যে, সুলতান আইয়ূবী যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত আর এ সুযোগে শত্রু বাহিনী আকস্মিক হামলা করে বসল। আপনি কি বুঝতে পারেন তখন এর পরিণতি কি হবে?