সাইফুদ্দীন! বিস্ময়ে অভিভূত কণ্ঠে বলল হারেস। সে এখানে কোত্থেকে এল?
পরাজিত হয়ে। কানে কানে বলল বৃদ্ধ। এসো বাবা! আগে ভিতরে এসে স্থির হও। তারপরে সব বলা যাবে। ঘোড়া দুটো বেঁধে রেখে দাউদ ও হারেস ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। হারেসই ছিল বৃদ্ধের সেই ছেলে; যার কথা সে সাইফুদ্দীনকে বলেছিল। দাউদকে হারেস তার শয়ন কক্ষে নিয়ে গেল এবং পরিচয় দিতে দিতে বলল, এর নাম দাউদ। তার মত বন্ধু আর হতে পারে না।
তুমিও কি পালিয়ে এসেছ? জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ।
না আমি সৈনিক নই, জবাব দিল দাউদ। মৌসুল যাচ্ছিলাম, যুদ্ধ আমাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। পথে হারেছের সাথে দেখা। তার সাথে এখানে এলাম।
আব্বা! আমাকে বলুন তো, মৌসুলের গভর্নর এখানে কি করে এল? তীর্যক ভাষায় জানতে চাইল হারেস।
পিতা বললেন, আজ রাতেই এরা এসেছে। সাথে ডিপুটি ও এক কমান্ডার ছিল। ওদেরকে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি শুধু এতটুকু শুনতে পেয়েছিলাম, সাইফুদ্দীন ডিপুটিকে বলছিল, বিক্ষিপ্ত সৈনিকদেরকে একত্রিত করে আমাকে বল আমি কবে নাগাদ মৌসুল আসব এবং কতদিন পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে থাকব…। এতটুকুই আমি দরজার এপাশ থেকে শুনতে পেয়েছিলাম।
আপনি কি এদের কথায় মনে করেন যে, এরা আবার সৈনিকদের পুনর্গঠিত করে প্রতি আক্রমণ করবে? বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল দাউদ।
এ মুহূর্তে এরা খুব ভীতু। আমাকে সাইফুদ্দীন অনুরোধ করেছিল, কেউ যেন তাদের অবস্থান জানতে না পারে। বৃদ্ধ আরো বলল, আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা এদের আছে। এই উদ্দেশেই কোন অজানা গন্তব্যে কমান্ডারকে পাঠিয়েছে।
আমি একে হত্যা করব, বলল হারেস। মুসলমানকে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহু আকবার তাকবীর বলে ভাই ভাইকে হত্যা করছে। ও আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলেছে। হারেস খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠল, দেয়ালে ঝুলন্ত তার বাবার তরবারি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্ধত হল।
তার বাবা পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরল তাকে। দাউদ তার বাজু ধরল। অসহায় হয়ে পড়ল হারেস। পিতা তাকে বলল, আগে আমার কথা শোন। দাউদও তাকে বলল, আগে মাথা ঠাণ্ডা করে কি করতে হবে ভেবে নাও। আমরা তাকে হত্যা করেই স্বস্তি নেব কিন্তু এর আগে আমাদের ভাবতে হবে একে হত্যা করা যতটুকু সহজ, ধকল সামলানো অত সহজ নয় হারেস পিতা ও দাউদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেল বটে কিন্তু রাগে ক্ষোভে ফোঁসতে লাগল। তার চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
একে হত্যা করা কোন কঠিন কাজ নয়। হারেসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল তার পিতা। সে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ওকে তো আমার এ দুর্বল হাতেও হত্যা করা সম্ভব। ওর লাশ গুম করে ফেলাও তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এর যে দুই সাথী চলে গেছে, ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে না। ওরা সন্দেহ বশত আমাদেরকে গ্রেপ্তার করবে। তোমার যুবতী স্ত্রী ও কিশোরী বোনের সাথে দুর্ব্যবহার করবে। আমরা যদি বলি গভর্নর এখান থেকে চলে গেছে তাহলে ওরা তা বিশ্বাস করবে না। কেননা গভর্নর তাদেরকে এখানেই ফিরে আসতে বলেছে।
মনে হয় আপনি সাইফুদ্দীনকে সত্য মনে করেন, একটু সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল হারেস। মুসলমানদের ভ্রাতৃঘাতী লড়াইকে কি আপনি ঠিক মনে করেন?
এটা ঠিক যে, আমার ঘরে আমি একে হত্যা করতে চাই না। বলল বৃদ্ধ। তবে আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি, তাকে আমি সঠিক মনে করি না। সে বলেছিল, তোমাকে তো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সমর্থক মনে হয়। সে আমাকে এই লোভও দেখিয়েছে যে, তোমার ছেলে যুদ্ধে মারা গেলে অনেক টাকা-পয়সা দেব। আমি উত্তরে তাকে বলেছি, আমি ছেলের শাহাদাত প্রত্যাশা করি, পুত্রের অপমৃত্যু বা পয়সার লোভ কখনো করি না। সাইফুদ্দীনের সাথীরা আমাদের মানসিক অবস্থা জানে। আমরা যদি তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলি তাহলে তার ডিপুটি আমাদের নিষ্কৃতি দেবে না। তারা বলবে, তুমি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সহযোগী। এজন্যই মৌসুলের গভর্নরকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছ।
দাউদ ভাই! তুমি বলতে আমি এখন কি করব? তুমি আমার আবেগ দেখেছ, তুমি তো বলেছিলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ পাপিষ্ঠকে হত্যা করার চেয়ে ভাল কাজ আর কি হতে পারে? যে হাজারো মুসলমান সৈনিককে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। অনেক সন্তানকে এতিম, স্ত্রীকে বিধবা, মায়ের কোল খালি করেছে। নাগালে পেয়েও একে হত্যা না করা আর একটি অপরাধ নয় কি? বল! তুমি জ্ঞানী মানুষ, আমাকে পথ দেখাও।
একটা মানুষকে হত্যা করলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। বলল দাউদ। তার অনেক সহযোগী ও সহকর্মী আলেপ্পো ও হিরনে রয়ে গেছে। এদের মধ্যে অনেক সাধারণ সৈনিক, কমান্ডার, সেনাপতি রয়েছে। শুধু সাইফুদ্দীনকে হত্যা করলে এরা সবাই সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সামনে হাতিয়ার ফেলে দেবে না। হাতিয়ার সমর্পণ করানোর কৌশল ভিন্ন। এজন্য প্রয়োজন এদেরকে সুকৌশলে রণাঙ্গনে নিয়ে এভাবে বিপন্ন করা যাতে এরা আত্মসমর্পণ করে এবং আইয়ূবীর দেয়া শর্ত মানতে বাধ্য হয়।
এ কাজ আইয়ূবী ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব? আমার বুকের মধ্যে যে আগুন জ্বলছে এটা কিভাবে নিভবে? এতিম মুজাহিদ সন্তানেরা কি আমাকে ক্ষমা করবে?