প্রতিপক্ষের উদারতায় আমার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রণক্ষেত্রে শত্রু সৈনিক কখনো জীবন ভিক্ষা দেয় না। আমি ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলাম। অনির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হলাম। পথটা ছিল নিরাপদ, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি রণাঙ্গন থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এলাম। সন্ধ্যা নেমে এল, পথেই একটা ঝোঁপের আড়ালে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে তিন সৈনিক আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, যারা আমার তরবারীর আঘাতে শহীদ হয়েছে। তাদের শরীর থেকে তখনো টপটপ করে রক্ত ঝরছে। এরা আমার চতুষ্পর্শ্বে ধীরে ধীরে ঘুরছিল, তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তারা আমাকে কিছু বলছিলও না, কিন্তু ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। শিশুদের মতো আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, প্রচণ্ড শীতের রাতেও আমি ঘেমে নেয়ে উঠলাম। ভীতি, শঙ্কায় আমার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। তায়াম্মুম করে নফল পড়তে দাঁড়ালাম, মনের অজান্তেই অঝোরে কান্না পেল। নামাযের ভিতরেই সশব্দে আমি আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাম……। লাগাতার তিনচার দিন এভাবে আমার কাঁটল। লোকালয় থেকে অনেক দূরে বিজন কণ্টকাকীর্ণ পথে ঘোড়া হাঁকিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। অনিদ্রা, ক্ষুধা, পিপাসা আমাকে দুর্বল করে ফেলল। কিন্তু ঐ মৃত তিন সৈনিকের আত্মা আমাকে তাড়া করছিল। আমি ঘুমাতে পাড়তাম না। দিনের বেলায়ও এদের অবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। আমি তাদের হাঁক শুনতে পেতাম। তাদের তাকবীর ধ্বনি আমার কানে বেজে উঠত। আমি এদিক-ওদিক তাকাতাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেতাম না। মনে হত আমার পেছনে কেউ আসছে, পেছনে তাকাতাম, কেউ নজরে পড়ত না। যে সৈনিক আমার পলায়ন দেখে ফেলেছিল সে যদি আমাকে হত্যা করে ফেলত তাহলে ভালোই হত। এই মরণ-যন্ত্রণায় আমাকে ভুগতে হত না। আমার জীবন ভিক্ষা দিয়ে সে বড় জুলুম করেছে। অবস্থা এমন। হল, আমার হাতে তরবারি থাকলে আমি আত্মহত্যা করতাম। আমার মন আমাকে সারাক্ষণ এই বলে শাসাচ্ছিল, তুই রাসূলের তিন মুজাহিদকে হত্যা করেছিস, তোর মুক্তি নেই…!
তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে বলল দাউদ। এটা আল্লাহর রহমত যে, তুমি আত্মহত্যা করনি অথবা খোদাদ্রোহী সৈনিক হিসেবে নিহত হওনি। রণাঙ্গন থেকে তুমি পালাতে পেরেছ। এ থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ্ তোমার দ্বারা কোন ভাল কাজ নেবেন। আল্লাহ্ তোমাকে সুযোগ দিয়েছেন অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার, অপরাধের কাফফারা দেয়ার।
আচ্ছা বলতো, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সম্পর্কে আমাকে যা বলা হয়েছে এসব কি সত্য না মিথ্যা?
সম্পূর্ণ মিথ্যা, বলল দাউদ। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী খ্রীস্টানদের এখান থেকে বের করে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান আর সাইফুদ্দীন ও তার সহযোগিরা ক্ষমতা লিপ্সায় খ্রীস্টানদের ক্রীড়নক হয়ে ওদের স্বার্থ রক্ষা করছে, ওদের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলছে। বেঈমান কাফেরদের সহযোগিতায় আল্লাহর সৈনিক সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। দাউদ সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা বিস্তারিত বলল। অথচ সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে সাইফুদ্দীন বাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে কত অসত্য কথাই না সে শুনেছে। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী বিলাসী, ক্ষমতা লিন্দু। ওরা আরো বলেছিল, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী রণাঙ্গনেও তার আরাম-আয়েশের সকল সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। অথচ বাস্তবে আইয়ূবীর মধ্যে এসবের নাম-গন্ধও নেই।
আচ্ছা! আমাকে বল, আমি তিন সৈনিক হত্যার প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করব? দাউদকে জিজ্ঞেস করল সৈনিক। এই বোঝা যদি আমার হৃদয় থেকে অপসারণ না করি তবে আমাকে ভয়ঙ্কর পরিণতি বহন করতে হবে। এর প্রায়শ্চিত্তের জন্য যদি সাইফুদ্দীনকেও হত্যা করতে হয় তাও আমি করব। তবুও আমাকে আল্লাহর সৈনিক হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।
না, এমনটার দরকার হবে না, বলল দাউদ। আচ্ছা তোমার সাথে কি আমাকে নেবে?
তুমি কে? জিজ্ঞেস করল সৈনিক। ওহ্! এখন পর্যন্ত আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, কি তোমার নাম, কি তোমার পরিচয়, কোত্থেকে এসেছ, কোথায় যাবে?
কৌশলী পরিচয় দিল দাউদ। আমার নাম দাউদ, আমি মৌসুল যাচ্ছি। আমি ওখানকার বাসিন্দা। যুদ্ধের কারণে রাস্তা ছেড়ে এদিকে এসেছি। তোমার গ্রাম যদি পথে পড়ে তাহলে আমি সেখানে থামব।
আমার গ্রাম বেশি দূরে নয়, বলল সৈনিক। তুমি আমার গ্রামে না থামলেও আমি তোমাকে জোর করে থামাব। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, অস্থির চিত্তকে স্থির করেছ। এমন সুন্দর কথা জীবনে আমি কখনো শুনিনি। এখন আমি ঘরেই ফিরে যাব, জীবনে আর কোনদিন মৌসুল বাহিনীতে ফিরে যাব না। আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে।
* * *
মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীন বৃদ্ধের কুঁড়ে ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। লাগাতার কয়েক রাত সে ঘুমাতে পারেনি। সে এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল যে, তার ঘরের পাশেই দরজায় কড়া নাড়া এবং দুই আরোহীর আগমন ও অশ্বের হেষারব তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। তখন প্রায় মধ্য রাত। শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেল, তার কন্যা ও পুত্রবধূও জেগে উঠলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বৃদ্ধ বলল, মনে হয় সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তাড়িয়ে দেয়া মৌসুল বাহিনীর কোন কমান্ডার অথবা সৈনিক এসেছে। পথের পাশে বাড়ি থাকাই মুশকিল। বৃদ্ধ দরজা খুলল, বাইরে দুই অশ্বারোহী দাঁড়ানো। তারা ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে। হারেছ সালাম করল, বৃদ্ধ তাকে জড়িয়ে নিল বুকে। কিন্তু মুখে আবেগের কিছুই প্রকাশ করল না। শুধু বলল, বাবা! আমি বড্ড আনন্দিত যে, তুমি হারাম মৃত্যু থেকে বেঁচে এসেছ। অন্যথায় যতদিন আমি বেঁচে থাকতাম, আমাকে শুনতে হতো তোমার ছেলে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঈমানী মৃত্যুবরণ করেছে। সে দাউদের সাথেও মুসাফাহ্ করল। দাউদ কি যেন বলতে চাচ্ছিল, বৃদ্ধ ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে কানে কানে বলল, তোমাদের গভর্নর সাইফুদ্দীন ভিতরে ঘুমিয়ে আছে। আস্তে করে ঘোড়াদুটো ওপাশে বেঁধে রেখে ভিতরে এসো।