ইজাজ দুর্গ থেকে আলেপ্পো ছিল মাত্র তিন মাইল দূরে। রাতের আগেই আলেপ্পোয় এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল যে, আইয়ূবী ইজাজ দুর্গ অবরোধ করেছেন। রাতের বেলায় ইজাজ দুর্গ থেকে ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান শিখা আলেপ্পো থেকেও যখন গোচরীভূত হল তখন আলেপ্পোতে অবস্থানকারী গোমশতগীন, সাইফুদ্দীন ও মালিক আস-সালেহ-এর মধ্যে এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল যে, পিছন দিক থেকে আইয়ূবীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করা হবে কি-না। কিন্তু সেনাপতিরা একবাক্যে সবাই জানালো, সেনাদের মধ্যে লড়াই করার হিম্মত নেই। বাধ্য হয়েই আইয়ূবীর বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান স্থগিত করতে হল।
সাইফুদ্দীন ও গোমশতগীনের মধ্যে ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মত বিরোধও দেখা দিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে গোমশতগীন সাইফুদ্দীনকে হত্যার হুমকি দিলে সে ঐক্য ভেঙে তার অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে আলেপ্পো থেকে বেরিয়ে গেল। মালিক আস সালেহর বয়স তখন পনের। আইয়ূবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় রাজনীতি সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণা ছিল না কিন্তু এ দুই বছরে সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও খৃস্টানদের তৎপরতা দেখে সে অনেকটা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে, সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও খৃস্টানরা তাকে ব্যবহার করে নুরুদ্দীন জঙ্গীর রেখে যাওয়া সালতানাতকে ধ্বংসের জন্য আইয়ূবীর বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে। তাকে বিশেষ কোন সুবিধা দেয়ার জন্যে নয়।
গোমশতগীনের কার্যক্রম ও তৎপরতায় মালিক বুঝতে পারল যে গোমশতগীন আগাগোড়া একজন ধূর্ত মতলববাজ। সাথে সাথে সে গোমশতগীনকে বন্দী করে জেলখানায় অন্তরীণ করে ফেলল। মালিকের কাছে এই সংবাদও পৌঁছায় যে, গোমশতগীন মালিক আস সালেহকেও হত্যা করানোর ষড়যন্ত্র করে ছিল; তাই বন্দী করার তিনদিনের মাথায় মালিক গোমশতগীনকে জেলখানার ভিতরেই হত্যা করার নির্দেশ দিল।
আইয়ূবী ইজাজ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে রাতেই আলেপ্পো অবরোধ করলেন। আলেপ্পো ছিল ইজাজ থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। ইজাজ দুর্গের আগুন দেখেই আলেপ্পোর বাসিন্দা ও সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আলেপ্পোর সৈন্যরা এতটাই হীনবল হয়ে পড়ে যে আইয়ূবীর মোকাবেলা করার কথা ভাবতেও তাদের গায়ে কাঁটা দেয়। অপরদিকে কিছুদিন আগেও সুলতান আইয়ূবী আলেপ্পো অবরোধ করেছিলেন, কিন্তু আলেপ্পোর অধিবাসীরা সুলতানের বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, সুলতান অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আলেপ্পোবাসীর সেই সাহসিকতা এখন আর নেই। সবাই
ভীত সন্ত্রস্ত। যেন আলেপ্পা শহর একটি মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে।
* * *
অবরোধের দ্বিতীয় দিন মালিক আস সালেহ-এর পক্ষ থেকে সুলতানের কাছে এক দূত এল। দূত কোন শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আসেনি, এসেছে এমন এক মানবিক ও আবেগপূর্ণ পয়গাম নিয়ে যে পয়গাম সুলতানকে আবেগাপ্লুত করে ফেলল। পয়গামে লিখা ছিল, মরহুম নূরুদ্দীন জঙ্গীর কন্যা সুলতান আইয়ূবীর সাথে দেখা করার অনুমতি চায়।
নূরুদ্দীন জঙ্গীর এই কন্যার নাম ছিল শামছুন্নিসা। মালিক আস সালেহ-এর ছোট এই কিশোরীর বয়স তখন দশ/এগার বছর। মালিক যখন দামেস্ক ত্যাগ করে আইয়ূবী বিরোধী শিবিরে যোগ দেয় তখন তার মা মালিকের ভূমিকার বিরোধিতা করেন কিন্তু এই আপন ছোট বোনটিকে মালিক সাথে করে আলেপ্পোয় নিয়ে আসে। অপরদিকে নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী মালিকের মাতা রাজিয়া খাতুন আইয়ূবীর পক্ষাবলম্বন করে দামেস্ক ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।
সুলতান জঙ্গী তনয়াকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর দুই সেনাকর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে জঙ্গী তনয়া শামসুন্নিসা সুলতান আইয়ূবীর তাঁবুতে হাজির হল। আইয়ূবী জঙ্গী তনয়াকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শামসুন্নিসা আইয়ূবীর উষ্ণতায় খুব কাঁদল, আইয়ূবীও খুব কাঁদলেন। শামসুন্নিসার হাতে ছিল মালিকের লিখা পয়গাম। পয়গামে মালিক পরাজয় স্বীকার করে আইয়ূবীকে সুলতান স্বীকৃতি দিয়ে তার আনুগত্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। সেই পয়গামে একথাও লেখা ছিল যে, হিরনের সাবেক গভর্নর গোমশতগীনকে এখানে হত্যা করা হয়েছে, অতএব এখন হিরনও সুলতানের কজায় ধরে নেয়া যায়।
তোমরা এই মেয়েটিকে কেন নিয়ে এলে? সেনাকর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেন সুলতান। তোমরা কি এই পয়গাম নিয়ে আসতে পারতে না?
সেনাকর্মকর্তারা এ কথার জবাব না দিয়ে তারা জঙ্গী তনয়ার দিকে তাকাল। নূরুদ্দীন তনয়া শামসুন্নিসা সুলতানের উদ্দেশে বলল, মামুজান! আমাকে এরা নিয়ে আসেনি, আমার ভাই আমাকে আপনার এখানে পাঠিয়েছে। আমরা চাই, আপনি আমাদেরকে আলেপ্পোয় থাকার অনুমতি দেবেন এবং ইজাজ দুর্গও আমাদের কজায় দিয়ে দিবেন। আগামীতে কোনদিন আমরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।
সুলতান আইয়ূবী সেনাকর্মকর্তাদের দিকে ক্ষুব্ধ ও তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এই শর্ত আদায়ের জন্যে তোমরা মরহুম সুলতানের এই ছোট মেয়েটিকে নিয়ে এসেছো?
ঠিক আছে মা! ইজাজ দুর্গ ও আলেপ্পোর অধিকার তোমাদের হাতে আমি ছেড়ে দিলাম। সুলতান ইজাজ দুর্গ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।