সাদা পতাকা উড়তে দেখে সুলতান যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিলেন। চতুর্দিকে নেমে এল পিনপতন নীরবতা।
কতক্ষণ পর দুর্গের প্রধান ফটক পেরিয়ে কয়েকজন উর্ধতন সেনাকর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে শেখ সিনান বেরিয়ে এল। সুলতান প্রথানুযায়ী শেখ সিনানকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যাননি। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে শেখ সিনান ছিল অমার্জনীয় অপরাধে শাস্তিযোগ্য অপরাধী। সিনান ও তার কর্মকর্তারা যখন সুলতানের কাছে এলো তখন তিনি এদের বসার জন্যও বলেননি, দাঁড়ানো অবস্থায় রেখেই বললেন,
সিনান! তুমি আমার কাছে কি প্রত্যাশা কর?
প্রাণভিক্ষা, মহামান্য সুলতান! পরাজিতের কণ্ঠে বলল সিনান।
দুর্গের কি হবে? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।
আপনার ফয়সালাই আমি মাথা পেতে মেনে নেবো সুলতান।
যত তাড়াতাড়ি পার তোমার সৈন্য সামন্ত লোক লস্কর নিয়ে দুর্গ ত্যাগ কর। শুধু জীবন নিয়ে যাবে তোমরা; তোমার সৈন্যরা কোন অস্ত্র সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কেউই কোন জিনিসপত্র আসবাবপত্র নিয়ে যেতে পারবে না। খালি হাতে দুর্গ ত্যাগ করতে হবে। আর মনে রেখো, ইসলামী সালতানাতের সীমা অতিক্রম করার আগে কোথাও থামবে না। তোমার প্রভু খৃস্টানদের কাছে গিয়ে থামবে। এ কথাও শুনে যাও, যে চার ফেদাঈকে তুমি আমাকে খুন করার জন্যে পাঠিয়ে ছিলে ওরা সবাই নিহত হয়েছে। তবুও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। শান্তি পতাকা তুমি উড়িয়েছে। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তোমার শান্তি প্রস্তাবকে আমি সম্মান করলাম, কিন্তু তোমাকে আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন কি-না বলা মুশকিল। মনে রেখো, এখন থেকে নিজেদেরকে আর মুসলমান বলে পরিচয় দিবে না। আবারো যদি নিজেদের মুসলমান দাবী করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে জানতে পারি, তবে রোম সাগরে তোমার চেলাপেলাসহ সবাইকে ডুবিয়ে মারব।
বেলা যখন পশ্চিম আকাশের তলদেশে তলিয়ে যেতে উপক্রম তখন দীর্ঘ সারি বেধে ফেদাঈরা পরাজয়ে মাথা নীচু করে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্গ ছেড়ে। শেখ সিনান সেই সারির প্রথম ভাগে। তার শীর্ষ কর্মকর্তা মহলের নারী, নর্তকী, সেবিকা ও পেশাদার খুনীদের নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে।
রিক্ত নিরস্ত্র সিনান ও সিনানের সকল সৈন্য শান্ত্রী। বেলা ডোবার আগেই সুলতানের বাহিনী দুর্গের নিয়ন্ত্রণ কজা করল। জেলখানায় সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেয়া হল। দুর্গ থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা-দানা, হিরা-মুক্তা, উট, ঘোড়া ও আসবাবপত্র সুলতানের হস্তগত হল।
* * *
ঈসিয়াত দুর্গের দায়িত্ব একজন সেনাপতির হাতে দিয়ে রাতেই আইয়ূবী সুলতান পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি খুব দ্রুতই ইজাজ দুর্গ দখলে নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অভিযান পরিচালনার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। কদিনের মধ্যেই তিনি ইজাজ দুর্গ অবরোধ করলেন। ইজাজ দুর্গকে আলেপ্পোর শাসকরা নানাভাবে আরো বেশী দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেছিল। ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা ছিল অক্লান্ত। সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনীকে ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেনি।
সুলতান আইয়ূবী ঈসিয়াত দুর্গের মতো এতোটা সহজে ইজাজ দুর্গও দখল করে নিতে পারবেন এমন আশা তার ছিল না। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, ইজাজ দুর্গ অবরোধ করলে আলেপ্পোর সৈন্য পিছন দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তাই আলেপ্পোর যে কোন আক্রমণ প্রতিরোধের পূর্বপ্রস্তুতির ব্যবস্থাও তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য আলেপ্পোর বাহিনী তুর্কমানে পরপর পরাজিত হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল।
ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সুলতানের বাহিনীকে মোকাবেলা করল। একদিন একরাত পর্যন্ত সুলতানের সৈন্যরা দুর্গের ধারেপাশেই যেতে পারেনি। দুর্গ প্রাচীর ভাঙার জন্যে সুলতানের একটি ইউনিট দিনরাত চেষ্টা করেও প্রাচীরের কাছেই যেতে পারেনি। ইজাজ দুর্গের সৈন্য সুলতানের সৈন্যদের প্রতি অসংখ্য তীর নিক্ষেপ করে প্রাচীর থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছিল।
মিনজানিক থেকে বড় বড় পাথর দুর্গ প্রাচীরের প্রধান ফটকে নিক্ষেপ করা হলো। তেলভর্তি পাত্র নিক্ষেপ করে অগ্নিবাহী তীর দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হল তবুও দুর্গের প্রধান ফটক ভাঙা সম্ভব হচ্ছিল না। ইজাজের সৈন্যরা সুলতানের মিনজানিক ইউনিটের উপর শক্তিশালী ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করে বহু হতাহত করে ফেলল। সুলতানের মিনজানিক ইউনিট তবুও মিনজানিক চালানো অব্যাহত রাখল। অগ্নিবাহী তীর ও তেলভর্তি পাত্র নিক্ষেপে ইজাজ দুর্গের সৈন্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বালু ছিটিয়ে দেয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করে অনেকাংশেই আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল।
অব্যাহত পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিতীর নিক্ষেপে প্রধান ফটকের কাঠে আগুন ধরে পুড়ে গেল কিন্তু প্রধান ফটক ছিল শক্ত লোহার সঁচে তৈরী। কাঠ পুড়ে গেলেও ফটক পেরিয়ে কোন অশ্বারোহীর ভিতরে প্রবেশ সম্ভব ছিল না। কাঠ পুড়ে যে ফাঁক-ফোকর হয়েছে তাতে পদাতিক সৈন্যরা ফটকের ফাঁক দিয়ে ভিতরে যাওয়া সম্ভব মনে হলো। আইয়ূবী পদাতিক বাহিনীর একটি ইউনিটকে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। দ্রুতগতিতে একদল পদাতিক সৈন্য প্রধান ফটকের ফাঁক দিয়ে দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করল বটে কিন্তু প্রবেশ করা মাত্র ইজাজ সৈন্যরা তাদের কচুকাটা করে মাটিতে লুটিয়ে দিল। পিছনের পদাতিক সৈন্যরা তাদের লাশের উপর দিয়েই এগুতে থাকল। দীর্ঘক্ষণের হুড়োহুড়িতে প্রধান ফটকের লোহার ফ্রেম ভেঙে অশ্বারোহী প্রবেশের মত ফাঁক তৈরী হয়ে গেল। সুলতান এবার অশ্বারোহী ইউনিটকে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। অশ্বারোহী ইউনিট ফটকের ফাঁক গলে ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করল কিন্তু গেট দিয়ে এক সাথে দ্রুতগতিতে একাধিক অশ্বারোহী প্রবেশের সুযোগ ছিল না। ইজাজ বাহিনী অশ্বারোহীদেরও ধরাশায়ী করতে শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যে সুলতানের কয়েকশত সৈন্য শাহাদত বরণ করল। ইজাজ দুর্গের সৈন্য এতটাই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, সুলতানের বাহিনীর পক্ষে দুর্গের ভিতরে নিয়ন্ত্রণ কজা করা দুরূহ হয়ে পড়ল। সুলতান নির্দেশ দিলেন সৈন্যদের বল, ভিতরে গিয়ে যে যেভাবে পারে ছড়িয়ে পড়বে এবং অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করবে। ততক্ষণে প্রধান ফটক অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। অশ্বারোহীর ধাক্কা আর আঘাতে ফটকের লোহা দুমড়ে মুচড়ে ফাঁক হয়ে গেছে। কয়েকশত অশ্বারোহী দ্রুতবেগে দুর্গাভ্যন্তরে ঢুকে বেপরোয়া অগ্নিসংযোগ ও মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হল। ইজাজ বাহিনী সিংহের মতো অটল অবিচল থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেল কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হলো না। ততক্ষণে সুলতানের ঝটিকা বাহিনী দুর্গের সব স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ ইজাজ সৈন্যই আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেল। সামান্য কিছু শত্রুসেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হল আর বাকী হয় নিহত নয়তো বন্দী হলো।