সব শুনে সুলতান লিজার উদ্দেশে বললেন, তুমি আযাদ। তোমার ব্যাপারে তোমারই ইচ্ছা কার্যকর করা হবে। লিজা সম্ভবত নিজেকে কয়েদী ভাবছিল। কয়েদখানার পরিণতির জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করছিল লিজা। কিন্তু খোদ সুলতানের মুখে তার স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঘোষণা শুনে সে অবাক হয়ে গেল। ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমি জীবনের জন্যে নাসেরের সেবিকা হিসেবেই থাকতে চাই। লিজাকে জানান হলো, এ মুহূর্তে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর সান্নিধ্যে দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এরপর সময় ও সুযোগ মত নাসের তার সাথে সাক্ষাৎ করবে।
হাসান বিন আব্দুল্লাহ ছিলেন সুলতানের গোয়েন্দা প্রধান। তিনি সব সময় এ ধরনের তরুণীদের পর্যবেক্ষণের জন্যে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার অধীনে রেখে গোপনভাবে ওদের খোঁজ খবর নিতেন। পর্যবেক্ষণের পর তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। নাসেরকে সেদিন সেনা ছাউনীতে চিকিৎসার জন্য বলা হলো। চিকিৎসকদের নির্দেশ দেয়া হলো দ্রুত সুস্থতা লাভের জন্য নাসেরের চিকিৎসার প্রতি সবিশেষ যত্ন গ্রহণ করা হোক।
* * *
গোমশতগীনের প্রতারণা ও ইপ্সিত লিজাকে না পেয়ে শেখ সিনান চরম ক্ষুব্ধ। কেউ তার পাশে ঘেষার সাহস পাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় মাত্র দুজন ফেদাঈ যখন তেরেসাকে বন্দী করে দুর্গে ফিরে গেল তখন শেখ সিনানের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। তার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বেরুতে শুরু করল। তেরেসাকে জিন্দান খানায় বন্দী করে নির্মম শাস্তি দিতে শুরু করল সিনান। তেরেসাও কম সুন্দরী ছিল না। কিন্তু শেখ সিনানের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল লিজার প্রতি। লিজাকে উদ্ধার করতে পারেনি ফেদাঈরা। নাসের ওকে ওদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে নিয়ে গেল।
এর কদিন পর ঈসিয়াত দুর্গের বহিঃদেয়ালের উপরে পাহারাদার সৈন্যরা দেখতে পেল বিশাল ধুলিঝড়ের মতো কি যেন এগিয়ে আসছে, কিন্তু তখন ধুলি ঝড়ের কোন আলামতই ছিল না। তাদের বুঝতে বাকী রইল না কোন অভিযাত্রীদল আসছে এদিকে। দেখতে দেখতে ধুলিঝড় আরো এগিয়ে এল। দৃশ্যমান হতে লাগল অশ্বারোহী বাহিনী। সম্ভাব্য বিপদাশঙ্কা করে যুদ্ধডঙ্কা বাজিয়ে দিল প্রহরীরা। দ্রুত খবর দেয়া হল শেখ সিনানকে। একটু পরেই দেখা গেল হাজার হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে দুর্গের দিকে।
অবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য দুর্গের উঁচু মিনারে চরে বাইরের দিকে তাকাল সিনান। ততক্ষণে সুলতানের বাহিনী বৃত্তাকারে দুর্গ অবরোধের জন্য ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। মিনার থেকে মোকাবেলার নির্দেশ দিল সিনান। ফেদাঈ তীরন্দাজরা সীমানা প্রাচীরের উপরে উঠে নিজের মতো করে অবস্থান নিল। কিন্তু আক্রমণ শুরু করল না। তারা প্রতিপক্ষের অবস্থা ও আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করল।
সুলতানের বাহিনী দুর্গাভ্যন্তরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত। হাসান বিন আলী ফেদাঈর কাছ থেকেই দুর্গের অবস্থা জেনে নিয়েছিলেন, তদুপরি নাসেরের প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনায় তিনি দুর্গাভ্যন্তর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছিলেন। দুর্গ অবরোধের সময় নাসেরও তাঁদের সাথে এসে যোগ দিল। নাসের তাদের বুঝিয়ে দিল দুর্গের কোথায় কি রয়েছে। নাসেরের কথা মত শেখ সিনানের প্রাসাদে আঘাত হানার জন্যে দুটি মিনজানিক (পাথর উৎক্ষেপণ যন্ত্র, যা সেই যুগের সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল) স্থাপন করা হল। মিনজানিক থেকে শেখ সিনানের প্রাসাদে নিক্ষেপ করা হল ভারী পাথর। প্রথম আঘাতেই প্রাসাদের ছাদের কতটুকু ভেঙে গেল। দুর্গপতির প্রাসাদে শুরু হয়ে গেল আর্তচিৎকার।
মিনজানিকের আক্রমণ শুরু হতেই দুর্গের দিক থেকে শুরু হল তীর বৃষ্টি। মিনজানিক চালকদের কয়েকজনকে ফেদাঈরা ধরাশায়ী করে ফেলল। ফেদাঈদের তীর বৃষ্টিতে মিনজানিক চালানো কঠিন হয়ে উঠলে পরিস্থিতি দ্রুত আয়ত্বে আনতে তেল ভর্তি মাটির পাত্র নিক্ষেপ করা হলো। মাটির তেল ভর্তি পাত্রগুলো মিনজানিকের দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়ে দুর্গের অভ্যন্তরে তেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে শুরু করল। সেই সাথে ছোঁড়া হলো আগুনবাহী তীর। কিন্তু নিক্ষিপ্ত তেলে তীরবাহী আগুন ধরানোর ব্যাপারটি সহজ ছিল না। উঁচু পাচিল টপকে তীর চালাতে না পারায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপ সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল দুর্গের ভিতরে পাচিলের কাছেই এক জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ধোয়ার উৎস লক্ষ্য করে তেলবাহী পাত্র নিক্ষেপ করলে সাথে সাথে সেই তেলে আগুন জ্বলে উঠল। দেখতে দেখতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল সিনানের প্রাসাদে। শুরু হল বিকট চিৎকার চেঁচামেচি। অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে শেখ সিনানের বেশী সময় লাগল না। প্রাসাদে আগুন ধরে গেলে দুর্গের ভিতর থেকে সে সাদা পতাকা উড়িয়ে শান্তির পয়গাম জানাল।
শেখ সিনান জানতো, আইয়ূবী কিংবা খৃস্টান বাহিনীর মতো তার সেনারা সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে অভ্যস্থ নয়। তাছাড়া নেশাকে পেশা হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেরাও নেশাসক্ত হয়ে পড়েছিল। অধিকাংশই নেশায় চুরচুর। এদের দ্বারা আইয়ূবীর বাহিনীর সাথে মোকাবেলা একেবারেই অসম্ভব। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা হবে সমূলে ধ্বংস হওয়ার নামান্তর। এরচেয়ে পরাজয় স্বীকার করে নেয়াই শ্রেয়।