মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ আর হাত ছাড়া করা যায় না।
নীচে আসতে দাও! সাথীকে এই বলে থামল এক ফেদাঈ।
তার নিরাপত্তা বাহিনী হয়তো কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
যাই হোক, আজ আর তাকে যেতে দেবো না। বলল অপর এক ফেদাঈ।
শুধু একজন যাবে। বলল ওদের দলনেতা। পিছন দিক থেকে আঘাত করতে হবে। প্রয়োজন পড়লে অন্যেরাও শরীক হবে।
সুলতান আইয়ূবী টিলার উপর থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে অন্যদিকে রওয়ানা হলেন। ফেদাঈ পিছনে পিছনে এগুতে লাগলো। কারণ সুলতানকে আঘাত করার মতো উপযোগী ছিল না জায়গাটি। সুলতান আবার ঘোড়া থেকে নেমে একটি টিলার উপরে উঠে গেলেন। একটু পড়েই টিলার উপর থেকে নেমে ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলেন। ফেদাঈরা তাঁর কাছেই লুকিয়ে ছিল, এরা এবার সুযোগ মনে করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। সুলতান অশ্বারোহণ করে ময়দানের দিকে যাওয়ার ইচ্ছায় অশ্বপৃষ্ঠে উঠতে যাবেন, ঠিক এ সময় তার কানে কারো দৌড়ানোর পায়ের আওয়াজ ভেসে এল। ঘাড় ফেরাতে ফেরাতে এক ফেদাঈ এক ফুট দীর্ঘ একটি খঞ্জর হাতে নিয়ে সুলতানের অবস্থান থেকে তিনচার হাত কাছাকাছি পৌঁছে গেল। আইয়ূবী তাকে দেখে ফেললেন।
দ্রুত তার খঞ্জর বের করে ফেললেন সুলতান। ফেদাঈ আঘাত হানল সুলতান তার হাতলে নিজের হাতল ঠেকিয়ে আঘাত রুখতে চাইলেন, কিন্তু ফেদাঈ ছিল ভীষণ শক্তিশালী, সে বাধা ঠেকিয়ে পুনরায় আঘাত হানতে উদ্যত হলো, কিন্তু এর আগেই সুলতান ফেদাঈকে আঘাত করলেন কিন্তু আঘাত রুখে দিল সে। টিলার ওপাশ থেকে তখন বেরিয়ে এল আরেক ফেদাঈ। এসে সুলতানকে পিছন দিক থেকে আঘাত করল। সুলতান সেই আঘাতও রুখে দিলেন কিন্তু তার বাজুর চামড়ায় আঁচড় লাগল। একাধিক আক্রমণকারীর আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সুলতান ঘোড়াকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। এক ফেদাঈ ঘুরে আঘাত করতে গেলে বাম হাতে ওর নাকের উপর দশাসই একটি ঘুষি বসিয়ে দিলে ওর মুখ থুবড়ে রক্ত পড়তে শুরু করল। সুলতান ওর পেটে খঞ্জরটি বসিয়ে দ্রুত বেগে বের করে ফেললেন। সেই সাথে ওকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। এরপর ফেদাঈ ছটফট করতে করতে মারা গেল।
অপর ফেদাঈও সুলতানের পিছন দিক থেকে আঘাত হানল। কিন্তু পূর্বের মতই এই আঘাতও সুলতান রুখে দিলেন। তবে ফেদাঈর খঞ্জরের মাথা সুলতানের উরুতে লেগে উরু কিছুটা কেটে গেল। আঘাতটি তেমন মারাত্মক ছিল বটে কিন্তু ইতিমধ্যে টিলার আড়াল থেকে আরো দুই ফেদাঈ দৃশ্যমান হল। এমন সময় অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে ফেদাঈদের ঘিরে ফেলল অশ্বারোহীরা। পালাতে চেষ্টা করল ফেদাঈরা কিন্তু অশ্বারোহীদের ক্ষীপ্ত আক্রমণে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়েই এক ফেদাঈ মরে গেল, আরেকজনকে তরবারীর আঘাতে মাথা উড়িয়ে দিল অশ্বারোহীরা। সুলতান অশ্বারোহীদের চিৎকার করে বললেন, ওদের হত্যা করো না, জীবন্ত ধরতে চেষ্টা কর। সুলতানের নির্দেশে পলায়নপর চতুর্থ ফেদাঈকে জীবন্ত ধরে আনল আবু আব্দুল্লাহর নিয়োগকৃত বিশেষ নিরাপত্তারক্ষীরা।
আল্লাহ্ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে সেদিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন সুলতান। সুলতানের নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন অনতিদূরের একটি টিলার উপর থেকে ভাগ্যক্রমে দেখে ফেলেছিল সুলতানের উপর ফেদাঈদের আক্রমণ। সেই সাথে সাথীদের প্রতি ইঙ্গিত করা মাত্র বিদ্যুৎগতিতে তারা এসে রুখে দেয় ফেদাঈদের। অন্যথায় সেদিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার দৃশ্যতঃ কোন উপায় ছিল না। হয়ত আইয়ূবীর ইতিহাস সেখানেই থেকে যেতো।
১৯৬৭ সালের মে মাস মোতাবেক ৫৭১ হিজরী সনের যিলকদ মাসে সুলতানের উপর ফেদাঈদের এই আক্রমণ হয়েছিল। ধৃত ফেদাঈকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, ঈসিয়াত দুর্গ থেকে আমরা চারজন এসেছিলাম। হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ফেদাঈকে জেরা করে ঈসিয়াত দুর্গ ও হাশিশ সম্রাট শেখ সিনানের আদ্যোপান্ত জেনে নিয়েছিলেন। হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ঈসিয়াত দুর্গের অবস্থা, অবস্থান, শক্তি ও সৈন্য সংখ্যার ব্যাপারেও বিস্তারিত তথ্য সগ্রহ করে সুলতানকে অবহিত করলেন।
সুলতান আইয়ূবী শেখ সিনানের অপকর্ম ও ধ্বংসাত্মক অবস্থা জ্ঞাত হওয়ার পর বললেন, আগামী রাতের শেষ প্রহরে আমরা ঈসিয়াত দুর্গের দিকে অভিযান শুরু করব। সকল সেনাধ্যক্ষ ও কমান্ডারদের তলব করে প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন সুলতান। ফেদাঈদের এই আখড়া উৎখাত করা বেশী জরুরী হয়ে পড়েছে। এটাকে কজা করে আমাদের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এক তৃতীয়াংশ সেনাই যথেষ্ট হবে। তিনি সেনাপতিদের অভিযানের কৌশল কি হবে তাও বলে দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় সুলতানকে খবর দেয়া হলো, নাসের এক ঝটিকা বাহিনীর সদস্য দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যেই হাসান বিন আব্দুল্লাহর কাছে নাসের তার ইতিবৃত্ত জানিয়েছে। দীর্ঘ বিরামহীন সফর, ক্ষুধা তৃষ্ণা ও আগুনে পোড়া মরুতাপে নাসেরের অবস্থা খুবই করুণ, লিজাও তাঁর সাথে। এমতাবস্থায়ই সুলতানের সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন গোয়েন্দা প্রধান। লিজার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। মৃতপ্রায় সে। চোখ কোটরে দেবে গেছে। রোদে পুড়ে সোনালী চেহারা তামাটে হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও কথা উচ্চারণ করতে পারছে না। তবুও ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হল সুলতান সকাশে। নাসের সুলতানকে তাদের হারিয়ে যাওয়া থেকে এখানে আসা পর্যন্ত আদিঅন্ত বিস্তারিত জানাল। লিজার আগমন ও তার মনে লিজার প্রেম ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও জানাল সুলতানকে।