সুলতান আইয়ূবীর একান্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার নিরাপত্তা নিয়ে সব সময়ই উদ্বিগ্ন। কারণ ইতিপূর্বে সুলতানের উপর অনেকগুলো প্রাণঘাতি আক্রমণ হয়েছে। দেখা গেছে, প্রতি মারণাঘাতের সময়ই সুলতান ছিলেন একাকী এবং তার নিরাপত্তা রক্ষীদের অবস্থান ছিল আশেপাশে। বেশীরভাগ আক্রমণ নিরাপত্তারক্ষীরা দ্রুত পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্বে এনে ঘাতকদের কাবু করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর থেকেই সুলতান তাঁর একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের আশেপাশে রেখে নিজে হারিয়ে যেতেন। এদিকে প্রধান সেনাপতি হাসান বিন আব্দুল্লাহ দূর থেকে সব সময় সুলতানকে নজরে রাখার জন্যে একটি চৌকস সেনা ইউনিট গঠন করেছিলেন। যাদের দায়িত্ব ছিল সুলতানের অজ্ঞাতেই তাঁরা সুলতানের নিরাপত্তার স্বার্থে তার উপর নজরদারী রাখবে। যাতে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত না ঘটতে পারে।
কিন্তু কেউ জানতো না, দীর্ঘদিন ধরেই চার ঘাতক ফেদাঈ সুলতানকে হত্যার উদ্দেশে মরুভূমিতে অহর্নিশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য আইয়ূবীকে খুন করা।
এরাই ছিল সেই ফেদাঈ যাদের সম্পর্কে ঈসিয়াত দুর্গপতি শেখ সিনান গোমশতগীনকে বলেছিল। এই চার খুনী ফেদাঈর পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ কবলিত এলাকার বিপন্ন মানুষের বেশে আইয়ূবীর সংস্পর্শে গিয়ে তাকে খুন করবে। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনার কোনই প্রয়োজন হলো না। এরা দেখল সুলতান আইয়ূবী কোন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই মরুভূমিকে একাকী ঘুরে বেড়ান। এটা ছিল ফেদাঈদের জন্যে দারুণ সুযোগ। শিকার না চাইতেই হাতের নাগালে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ফেদাঈদের অসুবিধা ছিল তীর ধনুকের অপ্রাপ্তি। মাত্র একটি তীর ও ধনুক থাকলেই তারা দূর থেকেই আইয়ূবীকে নিশানা করতে পারতো, কিন্তু তাদের পক্ষে তীর ধনুক বহন করা সম্ভব ছিল না। কারণ এতে আইয়ূবীর ভ্রাম্যমান গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে বড় ধরনের ছোঁড়া ও খঞ্জরই ছিল ফেদাঈদের প্রধান হাতিয়ার।
* * *
এদিকে লিজাকে ঘোড়ায় বসিয়ে নাসের উল্কার বেগে ঘোড়া দৌড়াল। লিজা তাকে বলে দিয়েছিল চার ফেদাঈ সুলতানকে খুন করার জন্যে অনেক দিন থেকে চেষ্টারত রয়েছে। নাসেরের একমাত্র লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে দ্রুত পৌঁছে সুলতানের বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে প্রধান সেনাপতিকে অবহিত করবে। কিন্তু নাসের চাইলেও তার পক্ষে খুব বেশী দ্রুত পৌঁছা সম্ভব ছিল না। একেতো তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অনেক দূর, তাছাড়া একই ঘোড়ায় দুজন আরোহী। তাকে বাধ্য হয়েই পথে থামতে হয়েছে, ঘোড়াকে দানাপানি খাইয়ে বিশ্রাম দিতে হয়েছে।
ঘটনাক্রমে নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুলতান আইয়ূবী একাকী ময়দানে চলে এলেন। চার ফেদাঈ সুলতানকে একাকী ঘুরতে দেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এই এলাকাটি ছিল সেনাবাহিনীর অবস্থান থেকে অনেক দূরে বিজন প্রান্তরে। আশেপাশে কোথাও লোকালয় ছিল না। এই বিজন প্রান্তরেই মরু-শিয়ালের মতো শিকারের খোঁজে থাকত ফেদারা। ময়দানেই রাত কাটাতো, সুলতানকে সুযোগ মত পাওয়ার অপেক্ষায় ফেদারা সুযোগের জন্যে প্রহরা গুনতো।
এদিকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নাসের লিজাকে নিয়ে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে। কিন্তু ঘোড়ার চাল বলে দিচ্ছে, তার দ্রুত চলার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে আসছে। নাসের ঘোড়ার বোঝা হাল্কা করতে এক লাফে মাটিতে নেমে লাগাম হাতে নিয়ে পায়দল চলতে শুরু করল। রাত বাড়তে লাগল নাসেরের সেদিকে খেয়াল নেই। লিজা তাকে বারংবার জানান দিচ্ছে; ঘোড়ার পিঠে আর বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর হাড়গুলোও ব্যথায় চুরচুর হয়ে গেছে। নাসের নিজেও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। তারও শরীর অবসন্ন কিন্তু তবুও যাত্রা বিরতি করেনি সে। সে লিজাকে বলল, লিজা! তোমার আর আমার জীবনের চেয়ে সুলতানের জীবন অনেক বেশী দামী। আমার বিলম্বের কারণে যদি সুলতানের কিছু হয়ে যায় তবে আমি মনে করব আমিই সুলতানের হন্তারক।
* * *
রাত শেষ হয়ে পূর্বাকাশে সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে নাসের তখন আর হাঁটতে পারছে না। পা টেনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগুচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে লিজা। ঘোড়া নিতান্তই ধীরগতিতে হাঁটছিল। এক জায়গায় ঘাস ও পানি দেখে থেমে গেল ঘোড়া। লিজা ঘোড়ার পিঠ থেকে মাথা তুলে বলল, আল্লাহর দোহাই নাসের! এটাকে আর তুমি টানা-হেঁচড়া করো না, একটু ঘাস পানি খেতে দাও।
ঘোড়া পানি পান করে নেয়ার পর নাসের সেটির লাগাম ধরে আবার চলতে শুরু করল। ঘোড়া আর দৌড়াতে পারছিল না। নাসের নিজেও হাঁটতে অক্ষম হওয়ায় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হল। লিজার দুধে-আলতা চেহারা নীল হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।
নাসেরের জানা ছিল না সুলতান এখন কোথায়? সুলতান তখন তুর্কমান ত্যাগ করে আরো অনেক সামনে অগ্রসর হয়েছেন; এমনকি তুকমানের পর কুহে সুলতান পেরিয়ে তিনি আরো সামনে চলে গেছেন। নাসেরের সামনে তখন আদিগন্ত তুর্কমান ময়দান। সে ভেবে কুল পায় না কিভাবে এই বিশাল ময়দান পাড়ি দেবে। সূর্য তখন মাথার উপরে উঠে গেছে।
* * *
সুলতান আইয়ূবী তার একান্ত কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে একটি বিজন পাথুরে টিলাময় প্রান্তরের পরিস্থিতি পরখ করার কাজে ব্যস্ত। একান্ত কর্মকর্তাকে এক জায়গায় রুখে দিয়ে তিনি একাকী হারিয়ে গেলেন। একটি টিলার উপরে উঠে তিনি চারদিক পর্যবেক্ষণ করছেন, সুলতান হয়তো তার সেনাদলের অগ্রাভিযানের কৌশল নির্ধারণের চিন্তায় ছিলেন, আর এদিকে সেই টিলার আড়ালেই লুকিয়ে থেকে সুলতানের গতিবিধি দেখছিল চার ফেদাঈ।