এর বেশী কিছু আমি জানি না। জবাব দিল লিজা। আমার সামনে এর বেশী কিছু বলা হয়নি।
আমার এখন উড়াল দিয়ে তুকমান পৌঁছা দরকার। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এ ব্যাপারে সুলতানের দেহরক্ষী ও সুলতানকে সতর্ক করা জরুরী।
লিজাকে সামনে বসিয়ে নিজে ওর পিছনে চড়ে ঘোড়া হাঁকাল নাসের। পরীর মতো সুন্দরী রূপসী একটি তরুণীর আগুনঝরা শরীর ওর বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে, ওর সোনালী রেশমী চুল উড়ে এসে চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু নাসেরের মধ্যে লিজার কোনই প্রভাব নেই। তার মন এখন শুধু সুলতান আইয়ূবীর নিরাপত্তা চিন্তায় বিভোর। যে কোনভাবে তুকমান পৌঁছানোই তার লক্ষ্য। তার দৈহিক উত্তেজনা, শিহরণ সব কিছুই লীন হয়ে গেছে সুলতানের জীবনাশঙ্কায়। কর্তব্যের অনুভূতি নিজের প্রেমকে দূর করে দিয়েছে। সে একজন যোদ্ধা হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। ফিরে পেয়েছে সে পূর্বের সেই গেরিলা কমান্ডারের সত্তা। শুধু যে নাসেরের এই পরিবর্তন তা নয়, লিজাও বদলে গেছে সম্পূর্ণরূপে। সে আর আগের মতো মায়াবিনী গোয়েন্দা তরুণী যাদুরাণী নয়, সে যে এক সুঠাম যুবকের বাহুবন্ধনে তার ইচ্ছার পুতুল, বিন্দুমাত্র তার মধ্যে সেই অনুভূতি নেই, নেই তারুণ্যের জৈবিক শিহরণ। সে যে এক তরুণী আর নাসেরের মতো এক টগবগে যুবকের বাহু বন্ধনে একই ঘোড়ায় আরোহী সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই লিজার। লিজার দৃঢ় বিশ্বাস, পাপ-পঙ্কিল জীবন ত্যাগ করে পুতঃপবিত্র জীবনের দিকে যাচ্ছি আমি, সেই জীবন দিতে পারে ইসলাম এবং নাসেরের মতো যুবকরাই সেই পবিত্র জীবনের প্রতীক। অতঃপর কদর্য ও অসুন্দরের কোন গন্ধ নেই তাদের স্পর্শ ও অবস্থানে যদিও তারা একই অশ্বপৃষ্ঠের আরোহী।
* * *
বোজা ও নবজ দুর্গের দুর্গপতিরা সুলতানের দূতের কাছে আত্মসমর্পণ করে দুর্গের অধিকার আইয়ূবীর হাতে তুলে দিয়েছিল। আইয়ূবী দুর্গের সৈন্যদেরকে তাঁর সেনাবাহিনীতে আত্মীকরণ করে দুর্গের মধ্যে বিশ্বস্ত একদল সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ কজা করলেন। কিন্তু ইজাজ দুর্গের দুর্গপতির ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ ও ঔদ্ধ্যত্য সুলতানকে আগ্নেয়গিরির মতো ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল। তিনি ইজাজ ও আলেপ্পোর দিকে অগ্রাভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন। বরাবরের মতো অগ্রাভিযানের আগেই তিনি অগ্রবর্তী গোয়েন্দা ইউনিট পাঠিয়ে দুর্গের অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি জানার ব্যবস্থা করলেন। গোয়েন্দাদের বলে দিলেন কিভাবে আলেপ্পো ও ইজাজ দুর্গকে কজা করতে হবে এ ব্যাপারে সার্বিক পরিস্থিতি তোমরা ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে আসবে। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে আলেপ্পো ও ইজাজ দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিপূর্ণ রিপোর্ট সুলতানকে জানিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সুলতান নিজেই ইপ্সিত লক্ষ্যবস্তুকে জানার জন্যে নিজেই সেখানকার ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়তেন। এ সময় তিনি বডিগার্ড ও সরকারী পাতাকাবাহীদের সাথে নিতেন না। লাল রঙের মধ্যে সাদা ডোরাকাটা তার একান্ত ঘোড়াও তিনি ব্যবহার করতেন না। কেননা, তার একান্ত ঘোড়াটিকে শত্রুবাহিনীর কমান্ডার চিনতো। বডিগার্ড ও সরকারী ঝাণ্ডাবাহীদের নিয়ে গেলে তো ব্যাপারটি আর গোপন রাখার উপায় ছিল না।
সুলতানকে অনুরোধ করা হয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া তিনি যেন কখনও একাকী কোথাও না যান। কিন্তু তিনি জীবনে কখনও নিজের নিরাপত্তার পরোয়া করতেন না। আর এ মুহূর্তে তার মন মেজাজ ছিল খুবই উত্তপ্ত। শত্রুদেরকে তিনি যেমন নাকানী-চুবানী খাইয়েছেন, শত্রুরাও তাঁর বাহিনীর অপরিমেয় ক্ষতিসাধন করেছে। যার ফলে শত্রুদের চূড়ান্ত আঘাত করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন অতি অল্প সময়ে ঘরের শত্রু বিভীষণদের খতম করে আসল শত্রুদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হতে।
এ অঞ্চলটি ছিল ঘন টিলা ও ঝোঁপ ঝাড়ে ভরা মাটিও পাথুরে। জায়গায় জায়গায় আবার গভীর গিরিখাদ। এসব এলাকায় একাকী বের হওয়া ছিল সুলতান আইয়ূবীর জন্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একদিন কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠেই প্রধান সেনাপতি হাসান বিন আব্দুল্লাহ তাকে বললেন, সুলতান মুহতারাম! আল্লাহ না করুন, কোন শত্রুদের প্রাণঘাতি হামলা যদি সফল হয়ে যায়, তবে ইসলামী সালতানাত আপনার মতো দ্বিতীয় কোন সুলতান জন্ম দিতে সক্ষম হবে না। আর জাতির কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্যে আমাদের কবরেও ভর্ৎসনা করে আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবে।
আল্লাহ্ যদি আমার মৃত্যু কোন ফেদাঈ কিংবা খৃস্টান গুপ্তচরের হাতেই লিখে থাকেন তবে তা-কি আমি রুখতে পারব? বাদশা যখন নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন আর সে জাতির ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধানের যোগ্য থাকে না। নিহত হওয়াই যদি আমার বিধিলিপি হয়ে থাকে তাহলে তো আমার কর্তব্য কাজটি সেরে ফেলার জন্যে তোমাদের উচিত আমাকে সুযোগ দেয়া। নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে আমাকে বন্দী করে রেখো না। আমার মনের মধ্যে রাজা বাদশাহের মতো রাজত্বের মোহ সৃষ্টি করো না। তোমরা তো জানো, কতবার আত্মঘাতি আক্রমণ হয়েছে আমার উপর, আল্লাহ্ প্রত্যেকবারই আমাকে হেফাযত করেছেন। এবারও সেই আল্লাহই হেফাযত করবেন। তিনিই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা দাতা!