লিজা! আর কদিন পর ওখানে গিয়ে দেখবে ফিদাঈ, তোমার সাথী ও অন্যান্যদেরও একই অবস্থা। হ্যাঁ, ওখানেও একই দৃশ্যের জন্ম হবে। মরদেহের কঙ্কাল, মাথার খুপরি, বর্শা, তরবারী, সবই ওখানে পাওয়া যাবে। ওখানেও হয়তো তুমি তেরেসার কঙ্কালে খঞ্জর বিদ্ধ দেখতে পারো, এরা যেমন নারীর জন্যে মরেছে, ওরাও নারীর জন্যই ধ্বংস হয়েছে। বলল নাসের।
হ্যাঁ, তাই ঠিক নাসের। বলল লিজা। আমি যদি আমার পেশা ত্যাগ না করি তাহলে আমাকেও এদের মতো করুণ পরিণতির শিকার হতে হবে। এমন মরু প্রান্তরে একদিন আমার এই সোনার দেহ নিয়ে শিয়াল শকুনে কাড়াকাড়ি করবে। আজ আমার দেহ পাওয়ার জন্যে যারা আমাকে আদর-সোহাগ ও মাল-দৌলত পেশ করে ওরাই এক সময় আমাকে হত্যায় প্রবৃত্ত হবে। নাসের! দুঃখের বিষয় মানুষ নিজ চোখে এসব করুণ পরিণতি দেখেও শিক্ষা নেয় না। মানুষ দেখে না, কত লোক বিত্ত, দৌলত, ক্ষমতা আর রূপ-যশের অহংকার অহমিকায় ধ্বংস হয়েছে। নাসের! আমি আত্মপরিচয় জেনে গেছি, আমি দেখে ফেলেছি আমার পরিণতি। নাসের! তুমিও শুনে রাখো, খোদা তোমাকে দিয়েছে সুপৌরুষ ও সুন্দর চেহারা। আমার বিশ্বাস; যে কোন বোদ্ধা নারী তোমাকে দেখলে একান্তে পাওয়ার লোভ করবে। এমতাবস্থায় তোমারও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। ওই বর্শা, তরবারী আর নরকঙ্কালগুলো দেখে নাও। ওগুলোতে দেখতে পাবে তোমার মতো পুরুষেরও করুণ পরিণতি।
লিজা এভাবে কথা বলছিল যেন জিনে ধরেছে তাকে। সে দুনিয়াত্যাগী দরবেশের মতো গুরু-গম্ভীরভাবে এসব কথা বলছিল, যেন জীবনের যাবতীয় চাকচিক্য ধোকা প্রতারণার পরিণতি দিব্য চোখে দেখছে সে, আসলে নিজের জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির স্বরূপ তার চোখে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল।
নাসের! আমার আসল পরিচয় আজ আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। বলল লিজা। আমি তোমাকে দেখাব আমার রূপ ও জৌলুসের বৈশিষ্ট্য। সে তার বুকে একটা থাপ্পর মেরে নীরব হয়ে গেল। সে তার গলার সোনার হারটি একটানে ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় নিল এবং ঝর্ণার স্রোতে ছুঁড়ে দিল। হাতের আঙুল থেকে হীরার আংটি খুলে পানিতে নিক্ষেপ করল। বলতে লাগল, আমিও এক মহা ধোকা, মায়াবিনী মোহমায়া নাসের। আমিও তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছিলাম।
তোমার প্রতি আমার হৃদয়ের টান থাকলেও আমার কর্তব্যের ভূত আমার ঘাড় থেকে কখনও নামেনি। ফেদাঈদের হামলা আমার চোখ খুলে দিয়েছে এবং এসব নরকঙ্কাল আমার চোখের সামনে কঠোর বাস্তবকে উন্মোচন করে দিয়েছে, আমি নিজের চোখেই আমার মৃত্যু আর লাশ দেখতে পাচ্ছি। এই দৃশ্যের মুখোমুখি না হলে আমি জানতাম না, যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখানে তোমার ভাগ্যে কি জুটতো। আর আমার ভালোবাসা, আমার প্রেমেরই বা কি পরিণতি ঘটতো। নাসের, কঠিন ধোকার শিকার হয়ে পড়েছিলে তুমি। এখন তোমাকে সব সত্য ঘটনা বলে দিচ্ছি, আমি এই আশায় তোমার সাথে প্রেমের ভান করছিলাম যে, তোমাকে আমার প্রেমের ফাঁদে ফেলে তোমাকে দিয়েই আইয়ূবীকে হত্যা করাব। গোমশতগীন আইয়ূবীকে খুন করানোর জন্যে ভাড়াটে খুনী আনার জন্যে শেখ সিনানের দুর্গে গিয়েছিল। সিনান বলেছিল, আইয়ূবীকে হত্যা করার জন্যে খ্রিস্টানদের সাথে কৃত চুক্তি মতো সে চার ফেদাঈ পাঠিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত সে চারজন আইয়ূবী হত্যা মিশনে কাজ করছে। এরা যদি আবারও ব্যর্থ হয় তবে সে আর কোন ফেদাঈকে আইয়ূবী হত্যার জন্য পাঠাবে না। কারণ সে নাকি আইয়ূবী হত্যা মিশনে অনেক ফেদাঈ হারিয়েছে। এক পর্যায়ে আমাদের কর্মকর্তা সেই দুর্গে এসে পড়ল। গোমশতগীন আইয়ূবী হত্যার জন্যে সহযোগিতা চাইলে সিনান বলল, আইয়ূবীকে হত্যা করতে তোমরা পারবে না, আমরা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর চার যোদ্ধা তোমাকে দিচ্ছি, এদের তৈরী করে সাইফুদ্দীনকে খুন করিয়ে ফেল, তাহলে তোমার একচ্ছত্র আধিপত্য আরো সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু আমাদের অফিসার গোমশতগীনকে বলল, সাইফুদ্দীন কোন জরুরী ব্যাপার নয়, আপনার জন্যে জরুরী হলো আইয়ূবীকে হত্যা করা। এজন্যে আইয়ূবীর চার যোদ্ধাকে আপনি ব্যবহার করতে পারেন। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো, আমি যাতে তোমাকে আমার প্রেমের ফাঁদে ফেলে আইয়ূবী হত্যায় তৈরী করে নিই।
আমি বেঁচে থাকতে আইয়ূবীর দিকে বক্র দৃষ্টিতে তাকাব তাও আমার পক্ষে অসম্ভব লিজা। বলল নাসের। দুনিয়ার এমন যাদু, এমন কোন শক্তি নেই যে, আমাকে এতোটা বিভ্রান্ত করে ফেলবে।
হাসল লিজা। বলল, আমি মনেপ্রাণে কখনও এ মিশনকে গ্রহণ করিনি। অবশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই, আমরা কঠিন পাথরকেও পানি বানাতে পারি। এরপর লিজা তার অতীত জীবনের ইতিবৃত্ত সব জানাল। বলল, সাইফুদ্দীনের কাছে কতদিন কিভাবে কাটিয়েছে সে। সব শেষে নাসেরের কাছে জানতে চাইল, এতো পাপ-পঙ্কিলতা জানার পরও কি তুমি আমাকে গ্রহণ করবে? আমি… আমি এখন খাঁটি মনে ইসলামে দীক্ষিত হতে চাই নাসের!
তুমি যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে অতীত জীবনের জন্যে তওবা কর তাহলে তোমাকে গ্রহণ না করা হবে আমার জন্যে পাপ। তবে সুলতান আইয়ূবীর অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। বলল নাসের। আরও বলল, অতীতের সব গ্লানি সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দাও। তুমি যদি ভবিষ্যতে সুন্দর জীবনের আগ্রহী হও, তাহলে আমাদের ধর্মই একমাত্র তোমাকে কাঙ্ক্ষিত সুন্দর পুতঃপবিত্র জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আচ্ছা লিজা! তুমি কি জান, যে চার ফেদাঈ সুলতানকে খুন করতে তৎপর, এরা কোন বেশে গেছে এবং এরা কিভাবে সুলতানকে আক্রমণ করবে?