লিজাকে পড়ে যেতে দেখে ফেদাইরা ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে ওকে ধরে ফেলল। নাসের খুব দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে ওদের আঘাত করতে চাইলে ওরা নাসেরের আঘাতের মুখে লিজাকে সামনে ধরে দিল। এতে হতোদ্যম হয়ে গেল নাসের। এক পর্যায়ে নাসেরও নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। ঘোড়া থেকে নেমে নাসের দেখল তার আশেপাশে নিজেদের কেউ নেই। ঘেরাও এর মধ্যে নিজের ঘোড়া ও লিজাকে সামলাতে গিয়ে সাথীদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করার সুযোগ পায়নি সে। নাসের কয়েকবার ফেদাঈদের আঘাত হানল কিন্তু প্রতিবারই তার আঘাত রোধ করতে ফেদাঈরা লিজাকে সামনে ধরে দিল। অবশেষে জীবন বাজী রেখে শুরু করল ওদের সাথে বর্শাযুদ্ধ। একাকী চারজনের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজেও জখম হল কিন্তু ততক্ষণে আরো দুই ফেদাঈ কপোকাত। নাসেরকে আহত হতে দেখে লিজা চীৎকার শুরু করে দিল, নাসের! তুমি চলে যাও, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে, আমার জন্যে তোমার জীবনটা নষ্ট করো না নাসের, প্রভুর দোহাই! তুমি চলে যাও নাসের! তুমি একাকী এদের সাথে পারবে না, চলে যাও। কিন্তু নাসের মরিয়া হয়ে উঠল লিজাকে বাঁচাতে। এদিকে লিজাও সমানতালে চিৎকার করতে থাকল। এক পর্যায়ে নাসের চিৎকার করে বলল, চুপ কর লিজা! ওরা তোমাকে কখনও নিয়ে যেতে পারবে না।
হ্যাঁ। নিজের সংকল্প বাস্তবে প্রমাণ করে দেখাল নাসের। সব ফেদাঈকে মারাত্মকভাবে আহত করে দূরে সরিয়ে দিল নাসের। শেষ পর্যায়ে ওর সামনে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ রইল না। ময়দান ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর একটি ঘোড়াকে ধরে সেটিতে লিজাকে বসিয়ে নাসের চড়ে বসল তার পিছনে। খুব দ্রুত ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। যেখানটায় তাদের তাঁবু ছিল সেখানে এসে দেখে ময়দান একেবারেই ফাঁকা। কেউ নেই, সবই লাশ। কয়েকজন ফেদাঈ মারাত্মক আহত হয়ে মরণযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আর তার সাথীরা লড়াই করে সবাই মৃত্যুবরণ করেছে। খ্রিস্টান কর্মকর্তাও নিহত হয়েছে কিন্তু তেরেসাকে কোথাও দেখা গেল না। সেখানে বেশীক্ষণ না দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল নাসের। রাতের শেষ প্রহরের শুকতারা মিটিমিটি জ্বলছে। দিক ঠিক করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল নাসের। অনেক দূর এসে ঘোড়া থামাল সে।
লিজা! এখন বল, কোথায় যেতে চাও তুমি? তোমাকে একাকী পেয়ে তোমার অসহায়ত্বের সুযোগে আমি তোমার উপর নিজের মত চাপিয়ে দিতে চাই। তুমি যদি বল, তোমার এলাকায় পৌঁছে দিতে, আমি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করব। কারণ তুমি এখন আমার কাছে পবিত্র আমানত। এটা করতে গিয়ে আমি কারাবরণ করতেও দ্বিধা করব না।
তোমার সাথে আমাকে নিয়ে চল নাসের! তোমার আশ্রয়ে আমাকে নিয়ে নাও। বলল লিজা। বাকী রাত একটানা ঘোড়া হাকাল নাসের। ভোরের আলো পূর্বাকাশে উঁকি দিলে অন্ধকার কেটে যেতেই এলাকা পরিচিত মনে হলো। এ এলাকাতেই নাসের একবার তার দল নিয়ে ঝটিকা অভিযানে এসেছিল। এখানে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ী টিলা আর গিরিখাদ রয়েছে। যেতে যেতে নাসের একটি পাহাড়ী ঝর্ণার কাছে চলে এল। ঝর্ণাটি ছিল পাহাড়ের ঢালে। উভয়েই ঘোড়া থেকে নেমে প্রাণ ভরে ঝর্ণার পানি পান করল এবং ঘোড়াকেও পানি পান করাল। নাসেরের পরিধেয় কাপড় রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরে অসংখ্য জখম। কিন্তু ততক্ষণে জখম থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেছে। নাসের ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে দেখল জখমগুলো বেশী গভীর নয়। আবার রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে এই আশংকায় ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করল না। লিজা পানি পান করে টলতে টলতে একটু দূরে টিলার পিছন দিকে চলে গেল। ঝর্ণা থেকে উঠে নাসের ওকে খুঁজে বের করল। দূরে গিয়ে একটি বড় পাথরের উপরে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল লিজা। নাসেরের দিকে তার পিঠ। লিজার সামনে অনেকগুলো মৃত মানুষের হাড়গোড়। মাথা, খুলি, বুকের পাঁজর, হাত পায়ের হাড় যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত। গোটা শরীরের কঙ্কালও রয়েছে কয়েকটি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি তরবারী, বর্শাও পড়ে রয়েছে।
মাথার একটি খুলি লিজার সামনে। সম্ভবত কোন মেয়ে মানুষের মাথার খুলি হবে সেটি। মুখের হাড়ের সাথে একটু একটু চামড়াও শুকিয়ে রয়েছে। মাথার খুলির সাথে দীর্ঘ কয়েক গাছি চুল। এটি নিঃসন্দেহে নারীর কঙ্কাল। উরুতে বর্শা বিদ্ধ। গলার সোনার হাড়টি এখনও আটকে রয়েছে। কঙ্কালের চারপাশে রেশমী কাপড়ের ভেঁড়া টুকরো। নাসের পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে লিজার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। লিজা একমনে নারী কঙ্কালে মগ্ন। হঠাৎ দুহাত কানে চেপে বিকট চিৎকার মারল লিজা এবং চকিতে মুখ ঘুরিয়ে উঠে পড়ল। খপ করে ওকে ধরে ফেলল নাসের। জড়িয়ে নিল বুকে। কাঁপতে শুরু করল লিজার শরীর। নাসের ওকে পাঁজাকোলা করে ঝর্ণার ধারে নিয়ে এল।
* * *
মাথায় পানি দিয়ে দীর্ঘ সময় শুইয়ে রাখার পর লিজা যখন স্বাভাবিক হলো তখন নাসের জিজ্ঞেস করল, তুমি চিৎকার করেছিলে কেন?
হায়! আমি আমার জীবনের করুণ পরিণতি দেখতে পাচ্ছিলাম। খুবই বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল লিজা। সম্ভবত তুমি কঙ্কালটি দেখে থাকবে। সেটি আমার মতোই কোন নারীর। সম্ভবত সেও আমার মতো রূপ সৌন্দর্যের যাদু ব্যবহার করতো, হয়তো যে কোন পুরুষকে সে রূপের ফাঁদে ফেলে নাকানী চুবানী দিতে পারতো, হয়তো সেই নারী ভাবতো, তার রূপ জৌলুস কখনও নিঃশেষ হবার নয়, সে চির সজীব হয়ে চিরদিন একইভাবে থাকবে। তুমি কঙ্কালটির উরুতে বিদ্ধ খঞ্জর দেখেছ? গলায় সোনার হার দেখেছো? এই খঞ্জর আর এই সোনার হার যে উপাখ্যানের কথা বলে; সেটি আমারই জীবনালেখ্য। অন্য যে সব কঙ্কাল ও বর্শা তরবারী পড়ে রয়েছে তা শত সহস্রবার শোনা গল্পেরই প্রতিবিম্ব। এসব গল্প কখনও আমি গভীরভাবে অনুধাবন করিনি। কিন্তু আজ এই নারী কঙ্কাল দেখে আমার মনে হয়েছে; এ যেন আমারই মাথার খুলি, আমারই কঙ্কাল। এই শুকনো কঙ্কালে আমার শরীরের রক্ত মাংস সংযোজন করা হলে আমারই রূপ প্রতিফলিত হবে। আমি যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একদল বুনো শকুন খুবলে খুবলে খাওয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি করছে। একটি শকুন যেন আমার অক্ষি কোঠর থেকে চোখের মণি ঠোকর দিয়ে বের করে নিচ্ছে। একটি হায়েনাকে দেখলাম আমার তুলতুলে গোলাপী গণ্ডদ্বয়ের মসৃণ গোশত খুবলে নিচ্ছে, চিবুচ্ছে। জঙ্গলী জীব-জন্তুরা আমার শরীরের সবকিছু লুটে নেয়ার পর কঙ্কালটি পড়ে রয়েছে। আমার মনে হলো, কঙ্কালের বিকশিত ভয়ানক দাঁতগুলো আমাকে ভর্ৎসনা করে বলছে, দেখো, দেখো, এই হবে তোমার পরিণতি। মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন কোন ভয়ঙ্কর জন্তু মুখ গহ্বরে নিয়ে আয়েশে চিবুতে শুরু করেছে।