লিজার বাহু ধরে নিজের দিকে টানল নাসের। লিজাকে কোলে তুলে নিল। লিজাও নাসেরের বুকে মাথা রেখে নিজেকে সঁপে দিল। লিজা ছিল উদ্ভিন্ন যৌবনা এক সুন্দরী তরুণী। জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতায় সে বিত্ত-বিলাসের জন্যে মোটেও লালায়িত ছিল না। লিজার জীবনে যেটির অভাব ছিল সেটি হলো, নির্ভরযোগ্য এক সুপুরুষের নিখাদ ভালোবাসা। লিজা ছিল ভালোবাসার ভিখারীনি। ভালোবাসার নামে সে পেয়েছিল কতগুলো নারীলোভী পাষণ্ডের পাশবিকতা, যেখানে হৃদয় বলতে কিছু নেই, সাময়িক ভোগ ও স্ফূর্তিই ছিল ওইসব ক্ষমতাবান বিত্তশালীদের নেশা।
নাসেরকে দেখে ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছার পথিমধ্যেই লিজার হৃদয়ের শূন্যতাটুকু তীব্র হয়ে উঠল। দৈহিক সৌন্দর্য, পৌরুষ, সততা ও অকপট মানসিকতা লিজাকে এতোটাই মুগ্ধ করে ফেলেছিল যে, ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছানোর পর তেরেসাকে না বলেই সে আবেগতাড়িত হয়ে চলে গিয়েছিল নাসেরের কক্ষে এবং বলেছিল, আমার উপর বিশ্বাস রাখো নাসের। লিজার মনে তখন কোন গোয়েন্দাগিরি কাজ করেনি, একান্তই সেটি ছিল তার হৃদয়ের সুপ্ত আকুতি, মনের একান্ত চাওয়া। সেদিন যদি তেরেসা লিজাকে ডেকে না নিয়ে যেতো; তাহলে সে কতক্ষণ নাসেরের কাছে কাটাতো এবং কি বলতো বলা মুশকিল।
তেরেসা এক পর্যায়ে লিজাকে দিয়ে নাসেরকে ফাঁসানোর চিন্তা করল। কিন্তু মনে-প্রাণে লিজা মোটেও নাসেরকে গোয়েন্দা জালে ফাঁসানোর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কর্তব্যের কারণে নাসেরকে অবশ্যই সে নিজের যাদুমন্ত্রে কজা করতে চাইল। কর্তব্য ও হৃদয়ের টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল লিজা। শেষ পর্যন্ত সে হৃদয়ের প্রশান্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে নাসেরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
নাসেরের জানা ছিল না, কাফেলা যখন বিশ্রামের জন্যে যাত্রা বিরতি করে তাঁবু তৈরীতে ব্যস্ত তখন গোমশতগীন লিজার কানে কানে বলেছিল, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চুপি চুপি তুমি আমার তাঁবুতে এসে পড়ো। কঠিন ফন্দি করে শেখ সিনানের গ্রাস থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে এনেছি। এসো, তোমাদের নেতাদের পাঠানো স্পেশাল সরাব আছে, খুব মজা হবে।
গোমশতগীনের প্রস্তাব শেষ হতেই খ্রিস্টান কর্মকর্তা লিজাকে ডেকে বলল, তেরেসা ঘুমিয়ে পড়লে আমার তাঁবুতে এসে পড়বে। প্রভুর মেহেরবানীতে তুমি বুড়োটার খপ্পর থেকে বাঁচতে পেরেছো, আমার তাবুতে এসো, খুব সুখ দেবো।
এসব প্রস্তাবে নিজের শরীর ও সৌন্দর্যের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল লিজার। সে কারো কথারই কোন জবাব না দিয়ে তাঁবুতে চলে গেল। তেরেসা সহসাই ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু লিজার চোখে ঘুম নেই। সে বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে নাসেরের দিকে রওয়ানা হল। ওদিকে নাসের তার জন্যে তৃষ্ণার্থ চাতকের মতো অধীর অপেক্ষায় নিঘুম প্রহর গুণছিল।
লিজা নাসেরকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে নাসের বলল, এই শোন! তুমি কি কোন অশ্বখুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো? মনে হয় কোন ঘোড়া ছুটানোর আওয়াজ?
হ্যাঁ। আওয়াজতো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় শেখ সিনান আমাদের ধাওয়া করতে সৈন্য পাঠিয়েছে, সবাইকে জাগিয়ে দেয়া দরকার।
নাসের দৌড়ে একটি টিলার উপরে উঠে গেল। সে দূরে দেখতে পেল অনেকগুলো মশাল ঘোড়ার দৌড়ের সাথে সাথে একবার উপরে একবার নীচে নামছে। নাসের বুঝতে পারল অশ্বারোহী অনেক। দেখতে দেখতে অশ্বখুরের আওয়াজ বাড়তে লাগল। নাসের দৌড়ে টিলার উপর থেকে নীচে নেমে এল। তাবুর কাছে এসে সবাইকে জাগিয়ে দিল। সে তার সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে টিলার কাছে চলে গেল। লিজাকে নিজের কাছে রাখল নাসের। বিপদের আশংকায় সবাই বর্শা ও তরবারী হাতে নিয়ে মোকাবেলার জন্যে তৈরী হয়ে গেল।
* * *
সিনানের প্রেরিত ফেদাঈ ছিল পনেরো ষোল জন। তন্মধ্যে সাতজনের হাতে মশাল। এরা এসেই সবাইকে ঘিরে ফেলল। ওদের একজন হুংকার ছেড়ে বলল, উভয় মেয়েকে আমাদের হাতে দিয়ে দাও, শেখ সিনানের নির্দেশ–মেয়েদের দিয়ে দিলে সবাইকে নির্বিঘ্নে ছেড়ে দেয়া হবে।
নাসের ছিল অভিজ্ঞ লড়াকু। সহযোদ্ধাদেরকে আগেই টিলার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল সে। ইশারা করল সাথীদের। অমনি সবাই এক সাথে ফেদাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নাসেরের সাথীরা বর্শার আঘাতে কয়েক ফেদাঈকে ধরাশায়ী করে ফেলল। নাসের সাথীদের উদ্দেশে চীৎকার দিয়ে বলল, ওদের ঘোড়র উপর সওয়ার হয়ে যাও। নাসের নিজেও ওদের একটি ঘোড়া ধরে তাতে সওয়ার হয়ে লিজাকে তার পিছনে তুলে নিল। বলল, খুব শক্ত করে আমার কোমড়ে ধরে রাখো, খেয়াল করো পা যাতে আটকে না যায়। সিনানের ফেদাঈরা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা হাতের মশালগুলো ফেলে দিয়েছিল। নাসের ও তার সহযোদ্ধারা মরণপণ মোকাবেলা করল। একটি ঘোড়া দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। পালিয়ে যাওয়া অশ্বারোহী ছিল গোমশতগীন। সে ছিল খুবই ধূর্ত ও চালাক। অবস্থা বেগতিক দেখেই পালিয়ে গেল। ফেদাঈরা নাসেরের ঘোড়ার উপরে লিজাকে দেখে ফেলেছিল। তারা চাচ্ছিল মেয়েটিকে জীবিত কজা করতে। তিন-চারজন অশ্বারোহী নাসেরকে ঘিরে বর্শা দিয়ে তার ঘোড়াকে আহত করার জন্যে আঘাত হানছিল। নাসের রণাঙ্গনের চিতা। সে বেষ্টনীর মধ্যেও নিজের ঘোড়ার দেহ অক্ষত রেখে দুই ফেদাঈকে ধরাশায়ী করল। তাকে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া দৌড়াতে হলো; সেই সাথে চকিতে মোড় নিতে হলো। লিজা এমতাবস্থায় নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তার পা পাদানী থেকে খসে পড়েছিল, এক পর্যায়ে দ্রুতবেগে ঘোড়ার মোড় নেয়ায় লিজা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।