আইয়ূবী জানতেন, ভোগবিলাসে লিপ্ত নীতিহীনরা যুদ্ধ ময়দানে টিকতে পারে। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার ছিল, আইয়ূবী জানতেন ওদের পিছনে রয়েছে ইহুদী, খ্রিস্টানদের অবারিত সাহায্য সহযোগিতা এবং পরামর্শদাতা। তাছাড়া আইয়ূবীর উঁচু পর্যায়ের কতিপয় সেনা কর্মকর্তাও লোভে পড়ে শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিল, যারা আইয়ূবীর যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে জানত। এরা এবং ইহুদী খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের সম্মিলনে আইয়ূবীর জন্যে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
দাউদ। আইউবীর বিশেষ গোয়েন্দাদের একজন। সেও মৌসুল পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে সাধারণ গ্রাম্য মানুষের পোশাকে বেরিয়ে পড়েছিল।
দাউদ দুআরত সৈনিকের কাছে ঘোড়া থামিয়ে দিল। সৈনিক এতোই ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে, আরেকটি অশ্বারোহীর আগমন মোটেও টের পেল না। দাউদ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলে সৈনিক হকচকিয়ে উঠল। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পিছনের দিকে তাকাল। দাউদ তার পাশে বসতে বসতে বলল, আমি বলতে পারি, তুমি যুদ্ধ ময়দান থেকে পালিয়ে এসেছো। তো ভাই! তোমার এই অবস্থা কেন? আহত কিংবা অসুস্থ হলে আমি তোমার সেবা করতে পারি।
না ভাই! আমার শরীরে কোন জখম নেই। আমি আহতও হইনি। কিন্তু আমার বুক ভেঙ্গে গেছে। দুঃখ সহ্য করতে পারছি না। আমি সৈনিক খান্দানের ছেলে। পেশাগতভাবে আমার বাবা ও দাদা সৈনিক ছিলেন। কিন্তু আমরা আল্লাহর পথের সৈনিক। ইসলামের জন্যে আমরা যুদ্ধ করি। পেশা হিসেবে নিলেও সত্যের পথে যুদ্ধ করা আমাদের হৃদয়ের খোরাক। আমি জানি খ্রিস্টান আমাদের শত্রু, আমাদের প্রথম কিবলা খ্রিস্টানদের কজায়। শত্রু-মিত্রের পার্থক্য আমি আমার সৈনিক বাবার কাছ থেকে শিখেছি। পারিবারিক ঐতিহ্য ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থে মৌসুল সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। কিন্তু কিছুদিন পরই আমাকে বলা হলো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী ইসলামের দুশমন, খ্রিস্টানদের মিত্র। খুব খারাপ লোক। অথচ আমরা জানতাম, আইয়ূবী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাইতুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন।
মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীন আমাদেরকে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠালো। রণাঙ্গনে পৌঁছে আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদেরকে ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে ঠেলে দিয়ে সাইফুদ্দীন নিজেকে সুলতান বানাতে চাচ্ছে। আইয়ূবীর সৈন্যরা চিৎকার করে আমাদের বলছিল, ভাইসব! আমরা সবাই মুসলমান। আমরা তোমাদের শত্রু নই, খ্রিস্টানরা আমাদের শত্রু। ক্ষমতালোভীদের প্ররোচণায় ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করো না। আমাদের সাথে এসো, এসো প্রথম কেবলাকে শত্রু মুক্ত করি। আমি তাদের পতাকা দেখেছি। কি সুন্দর কলেমা খচিত। দোস্ত! আমি আইয়ূবীর সৈনিকদের যেভাবে যুদ্ধ করতে দেখেছি, তাতেই আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে যে, তারাই সত্য পথে, আল্লাহর সাহায্য তাদের উপর রয়েছে। তাদের পরাজিত করার ক্ষমতা কারো নেই।
সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকদের তৎপরতা দেখে আমার হৃদয় আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠল। আমি রণাঙ্গন থেকে পলায়নের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার পাশেই ছিল একটি টিলা, আমি এর আড়ালে চলে গেলাম। আমার হৃদয়ে মৃত্যু নয় আল্লাহর ভয় তীব্র হয়ে উঠল। আমার বাহু শিথিল হয়ে গেল। তরবারীর ভার বহন করতে পারছিলাম না। ঘোড়ার লাগাম সামলাতে অক্ষম হয়ে গেলাম। ঘোড়াটিকে আমি টিলার আড়ালে নিয়ে গেলাম। আমি কাপুরুষ নই, কিন্তু কাপুরুষোচিত মৃত্যু আমাকে তাড়া করছিল। সারা শরীর অবশ হয়ে পড়ছিল। টিলার ওপাশে শোনা যাচ্ছিল তরবারির ঝনঝনানি, অশ্বের হ্রেষারব, সৈনিকের গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি। আইয়ূবী বাহিনীর সৈনিকেরা বলছিল, ভাইয়েরা! পবিত্র রমযানে ভাইদের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ করো না।
তাদের আহ্বান শুনে আমার হৃদয় রাজ্যে ভেসে উঠল, যুদ্ধে তো রোযা মাফ হয়ে যায়, কিন্তু সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকেরা ছিল রোযাদার। ইতিমধ্যে আমি প্রতিপক্ষের তিন সৈনিককে শহীদ করেছি। তাদের তপ্ত খুন আমার তরবারীতে লেগে জমে রয়েছে। যোদ্ধা তরবারীতে রক্ত দেখে উল্লসিত হয়, কিন্তু আমি তরবারীতে রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কেননা, আমার তরবারীতে ছিল ভ্রাতৃহত্যার খুন…!
এমতাবস্থায় যুদ্ধ করার সাহস আমি হারিয়ে ফেললাম। বের হয়ে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। আমি টিলার আড়ালেই দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনায় ধুকছিলাম। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর এক সৈনিক আমাকে দেখে ফেলল এবং আমাকে শাসাচ্ছিল। সে আমার দিকে বর্শা উত্তোলন করল, আমি তার ঘোড়ার পায়ে তরবারী ফেলে দিয়ে বললাম, আমি তোমাদেরই ভাই, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা আমার নেই। অদূরেই চলছিল প্রচণ্ড লড়াই। সম্ভবত সৈনিকটি ছিল আইয়ূবীর গেরিলা বাহিনীর সদস্য। সে লুকিয়ে থাকা শত্রু সৈনিকদের খুঁজছিল। সে অগ্রসর হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে তোমার অবস্থান সত্যের বিরুদ্ধে? আমি আমার অপরাধ স্বীকার করলাম। বললাম, এ অপরাধ আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে, আমাকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। সে আমার কাছ থেকে বর্শা নিয়ে নিল, তরবারী তো আমি আগেই সমর্পণ করেছিলাম। সে আমাকে ইঙ্গিতে বলল, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা কর। পেছনে তাকাবে না, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি তোমার জীবন ভিক্ষা দিলাম। যাও।