রাতের দ্বি-প্রহরে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দিলেন গোমশতগীন। থেমে গেল কাফেলা। গোমতগীনের জন্যে স্পেশাল তাঁবু টানানো হল। আর অন্যান্যদের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু টানানো হল। ঝটিকা বাহিনীর যোদ্ধা ও গোমশতগীনের দেহরক্ষীরা খোলা আকাশের নীচেই শুয়ে পড়ল। সবাই ছিল ক্লান্ত। শোয়ার সাথে সাথেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু নাসেরের চোখে ঘুম নেই। লিজাকে সে তাঁবু থেকে জাগিয়ে আনবে, না লিজা নিজেই তার কাছে চলে আসবে, এটা চিন্তা। করছিল নাসের।
নাসের ভুলে গেল যে, সে আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর একজন কমান্ডার। এ মুহূর্তে হয়ত তার সহযোদ্ধারা কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে, তাকেও নিজ সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে এ মুহূর্তটি পালানোর জন্যে সুবর্ণ সুযোগ। তার সাথীরা ছিল কমান্ডারের অনুগত। তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে, যখন প্রয়োজন বোধ করবে কমান্ডারই বলবে আমাদের কি করণীয়। পালানোর জন্যে এখানে ছিল পর্যাপ্ত আহার, পানীয়, সওয়ারীর জন্যে ঘোড়া এবং অন্যান্য আসবাব। খুব সহজেই এগুলো হাতিয়ে সাথীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে নাসের কিন্তু সেদিকে নাসেরের বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। তার সাথীরা জানে না তাদের দলনেতা খ্রিস্টান এক তরুণীর প্রেমে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে। স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে পড়েছে সে। তারুণ্য, নারীর রূপ-জৌলুস, মোহমায়া ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনার সর্বময় দোষণীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই তরুণী নাসেরের হৃদয় দখল করে নিয়েছে।
হঠাৎ নাসেরের কাছে একটি ছায়ামূর্তির আবির্ভাব মনে হলো। ছায়ামূর্তি সন্দেহাতীতভাবে নারীর। নাসের ছায়ামূর্তির আগমন অনুভব করে শয়ন থেকে উঠে বসল এবং ধীরে ধীরে তার সাথীদের থেকে একটু দূরে সরে গেল। ছায়াটি নাসেরের কাছে এসে থেমে গেল। কাঙ্ক্ষিত শিকারকে হাত করে ছায়ামূর্তি একটু দূরে একটি টিলার আড়ালে চলে গেল। ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, লিজা। দুজন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে বসে আবেগময় কথা বলতে শুরু করল। লিজাকে কাছে পেয়ে নাসের ভাবাবেগে উত্তাল। তার মুখে কথার ফুলঝুড়ি। কিন্তু লিজার মুখে কথা কম সে আবেগ প্রকাশ করছিল তার অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। তার মুখের চেয়ে শরীরের অঙ্গই বেশী ব্যাকুলতা প্রকাশ করছিল। এক পর্যায়ে লিজা নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে গম্ভীরভাবে নাসেরকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বলতো! তোমার জীবনে কি কখনও কোন নারী আসেনি?
আমার মা ও বোন ছাড়া জীবনে কখনও আমি কোন নারীকে স্পর্শ করিনি। বলল নাসের। তুমি যদি আমার জীবনের খোঁজ নাও, তবে দেখতে পাবে, যৌবনের প্রথম দিকেই আমি নূরুদ্দীন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হই, যতটুকু আমার অতীত মনে পড়ে, যৌবনের উচ্ছল দিনগুলোতে আমি যুদ্ধ, মরুভূমি, ঝটিকা আক্রমণ আর চিতাবাঘের মতো শত্ৰু শিকারের খোঁজে বন-বাদার, মাঠ-ঘাট চষে বেড়িয়েছি। যখন যেখানে থেকেছি কখনও স্বীয় কর্তব্য কাজে সামান্যতম অবহেলা করিনি। কর্তব্য পালনই আমার ঈমান। একথা বলে নাসের হঠাৎ কেঁপে উঠল, কিছুক্ষণ আনমনে কি ভেবে বলল, লিজা! সত্যি করে বলো তো, তোমরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমার মনে হয় তুমি আমার ঈমানকে নষ্ট করে দিচ্ছ।
নাসেরের কথার জবাব না দিয়ে লিজা জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে বলো! আমার প্রতি কি তোমার হৃদয়ে সামান্যতম ভালোবাসা আছে? না আমার রূপ দেখে তোমার মধ্যে পাশবিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে? লিজার কণ্ঠ ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার কণ্ঠে প্রেমভালোবাসা কিংবা ছেলেমীর কোন আভাস ছিল না। তার খুবই ভারী কণ্ঠ যেন নাসেরের কলিজা চিরে ভিতরের কথাটিও বের করে আনতে চায়।
তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার ভালোবাসাকে যেন আমি অপবিত্র না করি। এজন্য আমি তোমার কাছে এটা প্রমাণ করে দেখাব, নারীসঙ্গ জীবনে না পেলেও তোমাকে পেয়ে আমি উন্মত্ত পশু হয়ে যাইনি, আমি যথার্থই তোমাকে ভালোবাসি, এ ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। লিজা! তুমি আমাকে বলল, তোমাদের সমাজে কত শত দীপ্তপৌরুষ, বড় বড় ক্ষমতাবান, দাপটি অফিসার রয়েছে, আমার তো মনে হয় তোমার যে রূপ-জৌলুস, যে কোন বাদশার সামনে গেলেও তখত থেকে নেমে তোমাকে স্বাগত জানাবে, এরপরও তুমি আমার মধ্যে এমন কি গুণ দেখলে যে আমার কাছে প্রেম নিবেদন করছো?
নাসেরের কথায় নিরুত্তর লিজা। নাসের লিজার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বল লিজা! আমার কথার জবাব দাও?
দু হাঁটুর মাঝে মাথা লুকিয়ে ফেলল লিজা। নাসের ওকে বারবার বললেও কোন উত্তর দিচ্ছিল না। একটু পরেই কানে ভেসে এলো হেঁচকি। কাঁদছে লিজা। কেন কাঁদছে লিজা। পেরেশান হয়ে পড়ল নাসের। লিজাকে অনুনয় ভরে জিজ্ঞেস করল, লিজা! আমার কথার জবাব দাও, বল, কাঁদছো কেন? নাসের বুঝতে পারছিল না, মানবিক দুর্বলতায় তাকে যেমন কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত করে একটি বিধর্মী তরুণীর প্রেম অন্ধ করে দিয়েছে, তেমনি ভিন্নধর্মী লিজাকে তার নারীত্ব, প্রেম ও স্বচ্ছ ভালোবাসা নিজেকে নাসেরের বুকে লীন করে দিতে বাধ্য করেছে। এই দুর্বলতা এমন এক কঠিন জিনিস যে, এতে আক্রান্ত হলে রাজরানীও গোলামের পায়ে নিজেকে সঁপে দেয়, সম্পদ ও বিত্তের পাহাড়কেও ছাইভস্মের বাগাড় মনে করে ফকিরের পর্ণ কুটিরকেই রাজপ্রাসাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে রাজকন্যা।