সবকিছু গুছিয়ে গোমশতগীন শেখ সিনানের কাছে গেল বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে। বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় চলে যাচ্ছি। ওই চারবন্দীকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। সিনানের সাথে বন্দীদের ব্যাপারে মণি-মুক্তা ও সোনা-দানার বিনিময় আগেই সুরাহা করে রেখেছিল গোমশতগীন।
সিনান বলল, আমি যে চার ফেদাঈকে আইয়ূবী হত্যার জন্যে পাঠিয়েছি, মনে হয় তারা কাজ সেরে তবেই ফিরবে। তুমি এই চারজনকে দিয়ে সাইফুদ্দীনকে খতম করিয়ে দিও। তোমরা মুখোমুখি যুদ্ধে পেরে উঠতে পারবে না। যতটুকু পারো গুপ্ত হত্যার আশ্রয় নিয়ে কার্য উদ্ধার কর। আচ্ছা, তোমার খৃস্টান বন্ধু, আর ওই মেয়ে দুটো কোথায়?
ওরা তাদের কক্ষে আছে। জবাব দিল গোমশতগীন।
ওই মেয়ে দুটি সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেনি তো?
হ্যাঁ, ওই অফিসার মেয়ে দুটিকে বলছিল, আজ রাত সিনানের কক্ষে যেতে হবে। ওরা আপনাকে খুব ভয় করছে মনে হলো।
হু, বড় বড় বীর বাহাদুরও এখানে এসে কেঁপে উঠে। হতভাগা মেয়েটিকে নিয়ে এমন করছে যে এটি যেন তার নিজের সন্তান। বলল সিনান।
সিনানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পড়ল গোমশতগীন। পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল তার কাফেলা। সে অশ্বারোহণ করার সাথে সাথেই তার অগ্র-পশ্চাতে দুজন করে দেহরক্ষী অশ্বারোহণ করল। তাদের হাতে উদ্যত বর্শা। নাসের ও তার সাথীরা দেহরক্ষীদের পিছনে, তাদের পিছনে মালপত্র বোঝাই করা উট। দুর্গের প্রধান ফটক খুলে গেল। গোমশতগীনের কাফেলা বেরিয়ে এলো দুর্গ থেকে।
ঈসিয়াত দুর্গ থেকে বেরিয়ে গোমশতগীনের কাফেলা এগিয়ে চলল আর এদিকে দিবাকর দিনের শেষ আলো বিকিরণ করে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অল্প সময়ের মধ্যে সূর্য ডুবে গিয়ে কাফেলা ও ঈসিয়াত দুর্গের মধ্যে আঁধারের প্রাচীর টেনে দিল, এখন আর কারো চোখে ঈসিয়াত দুর্গের উঁচু খিলানগুলো নজরে পড়ছে না। বেলা ডোবার সাথে সাথেই দুর্গে সব ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হল। সীমানা প্রাচীরের ভিতরেও জায়গায় জায়গায় জ্বলে উঠল ফানুস। আঁধার ঘনিয়ে আসার পর শেখ সিনান একান্ত শান্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ঐ খ্রিস্টান বেটা মেয়েটিকে নিয়ে এখনো আসেনি?
শান্ত্রী বলল, না আসেনি। কয়েকবার শান্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল সিনান, প্রত্যেকবারই নেতিবাচক উত্তর পেল সে। অবশেষে একান্ত সেবককে ডেকে বলল, যাও, খ্রিস্টান বেটাকে গিয়ে বল, মেয়েটিকে নিয়ে এখনই আমার ঘরে আসতে।
সিনানের একান্ত প্রহরী খৃস্টান কর্মকর্তা যে ঘরে থাকতো সেই ঘরে প্রবেশ করে দেখল কেউ নেই। সেখানে খৃস্টান কর্মকর্তা, দুই তরুণী কারো চিহ্ন নেই, পুরো ঘর ফাঁকা। ঘর জনশূন্য দেখে ঘরের আশে-পাশে আনাচে-কানাচে, বাগানের ঝোঁপঝাড় পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও তরুণী কাউকেই খুঁজে পেল না। খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও মেয়ে দুটোর গায়েব হওয়ার সংবাদ শুনে সিনান রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। প্রধান সেনাপতিকে ডেকে সিনান বলল, দুর্গের প্রতিটি কোণায় কোণায় খুঁজে দেখ, যে করেই হোক মেয়ে দুটো ও খ্রিস্টান বেটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
খ্রিস্টান কর্মকর্তা ও দুই তরুণী লাপাত্তা হওয়ার সংবাদে গোটা দুর্গে হৈ চৈ পড়ে গেল। সবাই উদ্বিগ্ন। বেটা মেয়ে দুটো নিয়ে গেল কোথায়? রাতের অন্ধকারে শত শত মশাল দুর্গের দালান কোঠা, গলি ঘুপছি, ঝোঁপ-ঝাড় সব জায়গা তন্ন তন্ন করে তালাশ করল, কিন্তু তরুণী ও খ্রিস্টান কর্মকর্তার কোন চিহ্নও পাওয়া গেল না। শেখ সিনান দুর্গের প্রধান গেটের দ্বাররক্ষীদের ডেকে পাঠালো, ওদের কাছে জিজ্ঞেস করল, গোমশতগীনের কাফেলা ছাড়া আর কেউ কি গত দুএকদিনের মধ্যে দুর্গ থেকে বেরিয়েছে? দ্বাররক্ষীরা জানাল-গোমশতগীনের কাফেলা ছাড়া আর কেউ এ সময়ের মধ্যে দুর্গ থেকে বের হয়নি। দ্বাররক্ষীরা গোমশতগীনের কাফেলার লোক ও বহরের বিস্তারিত বর্ণনাও জানাল।
শেখ সিনান নিজের কক্ষে রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিল। তখন প্রায় রাতের এক প্রহর পেরিয়ে গেছে, এদিকে গোমশতগীনের কাফেলাও এগিয়ে চলছে। গোমশতগীন উট চালকদের উট থামাতে নির্দেশ দিলেন। বললেন, উটগুলো বসিয়ে ওদের বের করে ফেল, দেখো আবার মরে গেছে কি-না। উটগুলো বসিয়ে পিঠে বোঝাই করা তাঁবু খুলে বের করে আনা হলো খ্রিস্টান কর্মকর্তা, লিজা ও তেরেসাকে। ঘামে নেয়ে গেছে সবাই। ওদেরকে তাঁবু দিয়ে পেঁচিয়ে গোমশতগীন অন্যান্য মালপত্রের সাথে বেঁধে ঈসিয়াত দুর্গ থেকে লুকিয়ে নিয়ে এলো। এ মুহূর্তে ওরা ঈসিয়াত দুর্গ থেকে অনেক দূরে। তাদের ধারণা, ফেদাঈদের এ পর্যন্ত পশ্চাদ্ভাবন করার আশংকা নেই। কারণ ফেদাঈরা মুখোমুখি সংঘর্ষে অনুৎসাহী। তবুও ঝুঁকি এড়াতে গোমশতগীন কাফেলার যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। তরুণীদ্বয়কে উটের উপরে চড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তাকে ঝটিকা বাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে পায়দুল চলতে বলা হল। দুই তরুণী ও খ্রিস্টান কর্মকর্তার ঘোড়া ঈসিয়াত দুর্গেই ছেড়ে আসতে হয়েছে। খ্রিস্টান কর্মকর্তা ছিল মুসলিম এলাকার ভাষায় দক্ষ। সে মাতৃভাষাভাষীর মতোই নাসের ও অন্যান্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। এতে নাসেরের মন থেকে শঙ্কা আরো দূরে সরে গেল, সেই সাথে লিজার প্রতি টান আরো তীব্রতা পেল। নাসের চাচ্ছিল লিজার কাছাকাছি থাকতে, কিন্তু রাতের দ্বি-প্রহরের আগে আর লিজার পাশ ঘেঁষতে পারল না নাসের।