তোমাকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সমর্থক মনে হচ্ছে। তোমার উপর আমাদের ভরসা করা ঠিক হবে না। উম্মামাখা কণ্ঠে বলল সাইফুদ্দীন।
আমি তোমাদেরও সমর্থক। মূলত আমি ইসলামের সমর্থক, সত্যের পক্ষে। আমি তোমাকে বলতে চাচ্ছি যে, তুমি তোমার ধর্মীয় ভাইয়ের শত্রুকে বন্ধু মনে করছে। এ বিষয়টি মোটেও চিন্তা করোনি যে, এরা বন্ধু বেশে ইসলামের দুশমন, তোমার আমার সবার শত্রু। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈনিকরা অতর্কিতে এখানে আক্রমণ করলেও তোমাদের আমি লুকিয়ে রাখতে পারব।
ইত্যবসরে একটি কিশোরী খাবার নিয়ে এলো। তার পিছনে আসল এক যুবতী। কিছুটা বয়স্কা হলেও রূপ-লাবণ্য দৃষ্টি কাড়ার মতো। সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি কিশোরীর শরীরে আটকে গেল। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল সে।
কিশোরী খানা রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কিশোরী চলে যেতেই সাইফুদ্দীন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি কে?
মেয়েটি আমার কন্যা। আর যুবতী আমার পুত্রবধূ। আমার যে ছেলে মৌসুল সেনাবাহিনীতে চাকরী করে তার স্ত্রী। আমার মনে হয় যে, আমার এই পুত্রবধূটি বিধবা হয়ে গেছে। বলল বৃদ্ধ।
তোমার ছেলে মারা গিয়ে থাকলে আমরা তোমাকে অনেক টাকা দেব। বলল, সাইফুদ্দীন। আর মেয়ের ব্যাপারেও তোমাকে ভাবতে হবে না। একে কোন সিপাহীর বউ হয়ে কুড়ে ঘরে থাকতে হবে না। একে বিয়ের জন্য আমরাই পছন্দ করে নিয়েছি।
আমি আমার ছেলেকে বিক্রি করিনি, কন্যাকেও বিক্রি করতে চাই না। বলল বৃদ্ধ। কুড়ে ঘরে লালিত-পালিত কোন মেয়ের জন্যে সিপাহীর বউ হয়ে কুড়ে ঘরে থাকাই মানায়। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, আমাকে কোন লোভ দেখানোর দরকার নেই। মেহমানের মর্যাদা নিয়ে তোমরা থাক। আমাকে সেবা করার সুযোগ দাও।
তুমি শুয়ে পড়। তোমার উপর আমাদের আস্থা আছে। আমাদের দেশে এখনও তোমার মতো নীতিবান লোক রয়েছে, তা জেনে খুশী হলাম।
বৃদ্ধ চলে গেলে সাইফুদ্দীন সাথীদের বলল, এ ধরনের ব্যক্তিরা ধোকা দেয়। তোমরা কি বুড়োর মেয়েটিকে ভালভাবে দেখেছ?
একটা হিরের টুকরো। বলল ডেপুটি।
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে এলেই এই টুকরো আমার প্রাসাদেই থাকবে। স্মিত হেসে বলল সাইফুদ্দীন।
এবার ডিপুটির দিকে ঝুঁকে বলল, তুমি তাড়াতাড়ি মৌসুলের খবর নাও। সৈনিকদের একত্রিত করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে আমাকে শীঘ্রই সংবাদ দাও, আমি মৌসুল আসবো না এখানে আরো কিছুদিন থাকবো, জানাও।… আর তুমি, কমান্ডারের দিকে ঝুঁকে, শীঘ্রই আলেপ্পো যাও। ওখানে গিয়ে বলো, আমি কোথায় আছি। নিজে যাও, না হয় নির্ভরযোগ্য কাউকে পাঠাও।
ডিপুটি ও কমান্ডার তখনই রওয়ানা হয়ে গেল। যে সাইফুদ্দীন মদ, নারী ও মহলের ফরাশ ছাড়া ঘুমাতেপারে না, সে কাঁচা ঘরের চাটাইয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল।
একদিন আগের ঘটনা। রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে মৌসুলের দিকে যাচ্ছিল এক সৈনিক। কখনও সে ঘোড়া খুব দ্রুত দৌড়াত। কখনও থেমে পড়ত। পিছন দিকে তাকাতো। আর কখনো ধীরে ধীরে চালাত। বারবার বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতো পিছনের দিকে। এদিক ওদিক দেখতে এই বুঝি পিছনে কেউ ধাওয়া করছে ভেবে ভয়ে থমকে যেতো। রাস্তা ছেড়ে এবড়ো থেবড়ো পথে যাচ্ছিল সে। দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন। ভীত আতংকিত। কি করবে, কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এক জায়গায় এসে ঘোড়া থামিয়ে কেবলার দিকে ফিরে দুরাকাত নামায পড়ল সৈনিক। নামায শেষে দুআর জন্য হাত উঠিয়ে অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। হাত উঠাল তো উঠালো। আর নামানোর নাম নেই। আকাশের দিকে মুখ করে ঠাই বসে রইল।
স্বজাতি গাদ্দার সম্মিলিত তিন কুচক্রীর সৈনিকেরা যখন আইয়ূবীর কাছে পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করেছিল তখন এদের পোশাকেই আইয়ূবীর চৌকস গোয়েন্দারা পলায়নপর সৈনিকদের সহগামী হয়ে গেল। এটা ছিল আইয়ূবীর একটি গোয়েন্দা কৌশল। পরাজিত পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে তার কিছু সংখ্যক গোয়েন্দা মিশে যেত। এরা এদের সাথে চলে যেতো তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এবং বহুরূপী বেশ ধারণ করে পর্যটকের মতো শত্রুদের অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে প্রতিপক্ষের পরবর্তী তৎপরতা এবং সাধারণ মানুষের মনোভাব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো। দামেস্ক থেকে মালিক আস-সালেহ পলায়নের সময় আইয়ূবীর বহু গোয়েন্দা সাধারণ মানুষের বেশ ধরে ওদের পিছনে চলে গিয়েছিল। এসব গোয়েন্দা খুব মেধাবী, সাহসী, দৃঢ়চেতা, দুরবস্থার মধ্যেও লক্ষ্যে অবিচল থাকার মতো করে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা হতো। যুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমেই আইয়ূবী বিজয়ের অর্ধেক অর্জন করে ফেলতেন, বাকী অর্ধেক বিজয়ের জন্যে তাকে ময়দানে লড়তে হতো।
১১৭৫ সালের এপ্রিলে সম্মিলিত কুচক্রী বাহিনীর পরাজয়ের সাথে সাথেই আইয়ূবীর সেনাপতি হাসান আব্দুল্লাহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দাদের পলায়নপর সৈনিকদের পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওদের পোশাকে সজ্জিত করে। এরা হিরন ও মৌসুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। তন্মধ্যে অনেকেই গ্রাম্য মানুষের পোশাকেও ছিল।
তিন কুচক্রীর মধ্যে পরস্পর সদ্ভাব মোটেও ছিল না। তিনজনই ছিল ক্ষমতা লোভী এবং একে অন্যের শত্রু। কিন্তু বিশাল সাম্রাজ্যের লোভে এরা আইয়ূবীকেই শত্রু ভাবতে থাকে এবং আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধের আয়োজন করে বসে। তাই আশঙ্কা ছিল এরা লজ্জাজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সৈন্যদের সংগঠিত করে আবার প্রতি আক্রমণ চালাতে পারে। এজন্য এদের তথ্য নেয়ার বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।