সাথীদের সে জাগাল না। উঠে দরজার কাছে দাঁড়াল নাসের। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল সৈন্যদের আনাগোনা। ভাবনায় পড়ে গেল, এই সৈন্যরা কারা? এই দুর্গ কাদের? কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক মনে করল না সে। কারণ দুর্গটি কোন শত্রু বাহিনীরও হতে পারে। তাহলে কি সাথীদের নিয়ে বন্দী হয়ে পড়েছে সে? কিন্তু ঘরটিকে দেখে কয়েদখানা মনে হয় না। সে একজন গোয়েন্দা এবং অভিজ্ঞ সৈনিক। কাউকে কিছু না বলে জিজ্ঞেস না করেই নিজে নিজে এই রহস্যের কিনারা করতে ভাবতে লাগল। হাশীশের নেশা এখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে নিজের প্রকৃত অবস্থায় ফিরে এসেছে। একটা গভীর সংকটের আঁচ করল নাসের। দরজার কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এমন সময় দুজন লোক প্রবেশ করল কক্ষে। কৃত্রিম নাক ডাকার শব্দ শুরু করে দিল নাসের।
মাত্র শুয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। বলল একজন।
থাক। ওদের ঘুমিয়ে থাকতে দাও। বলল অপরজন। মনে হয় এদেরকে বেশী খাইয়ে ফেলেছে। এদের সম্পর্কে কিছু বলেছে কি?
দুই খৃস্টান তরুণী এদের ফাঁসিয়ে নিয়ে এসেছে। বলল প্রথম জন। এরা সালাউদ্দীন আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীর চৌকস গোয়েন্দা। এদেরকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
চলে গেল তারা কক্ষ ছেড়ে। তাদের ভাষা বুঝল নাসের। অবস্থার ভয়াবহতায় শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল তার, কাঁটা দিয়ে উঠল শরীর। সে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, কোন দুর্গে বন্দী হয়ে পড়েছে তারা। ভয়ানক প্রতারণার শিকার হয়েছে সবাই। এখন তার জানা দরকার এই দুর্গ কাদের? এই এলাকাটি কোথায়? কোন উদ্দেশ্যে তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে? কোন উদ্দেশেই বা তাদের তৈরী করতে চায় এরা। সে জানে, কোন দুর্গ থেকে ফেরার হওয়া শুধু কঠিন নয় বরং অসম্ভব।
একটু ঘুমিয়েই জেগে উঠল ছোট তরুণী। জানালা খুলে বসে পড়ল সেখানে। সফরের সময় নিজের আবেগ ও মনের কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল বড় তরুণীর কাছে। সে সদ্য যুবতী। অন্যান্য গোয়েন্দা মেয়েদের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এখনও। এই প্রথম কোন মিশনে প্রশিক্ষণ শিবিরের বাইরে এসেছে। তার সাথী পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ। সেও দেখল আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই এই তরুণীর। এজন্য মিশনে সফল হতে পারছে না। পুরুষকে আঙ্গুলের ঈশারায় নাচানোর কৌশল এখনও রপ্ত করতে পারেনি। আসলে নিজের সত্তা বিকিয়ে গোয়েন্দাগিরির এই নোংরা পেশাকে সে মেনে নিতেই পারছিল না। যদ্দরুন এসব কৌশল রপ্ত করতে পারছিল না। ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন মুসলিম শাসক ও শেরিফদের বিনোদনের খেলনায় পরিণত হয়েছিল তরুণী। এমনিতেই দীর্ঘ বিরামহীন সফরে ক্লান্ত, তদুপরি পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। ক্লান্তিকর সফরের ধকলে শরীরটা নিস্তেজ। এর মধ্যে শেখ সিনানের মতো একটা বুড়োর কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাবে দেমাগ বিগড়ে গেল তরুণীর।
বিদ্রোহ করে বসল তরুণী। এখন কি করবে সে? বড় তরুণী যে কথা দিয়ে এসে সঙ্গিনীকে যে করেই হোক সিনানের কক্ষে পাঠাবে।
ছোট বেলায় গীর্জায় সুরক্ষিত ব্যবস্থায় এই তরুণীকেও দিয়ে ক্রুশের স্বার্থে সব ধরনের অপরাধ কর্ম সম্পাদনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যৌবন স্বভাবজাত তারুণ্যের নীতিবোধ ও অন্যায়ের প্রতি যে দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তা এই তরুণীকেও ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অন্যায়ের প্রতি বিদ্রোহ করে বসে তরুণীর যুবা মানস। খৃস্টধর্মের প্রতি তার মনের কোণে জমতে থাকে ঘৃণা। এই ঘৃণা ধ্বসিয়ে দেয় পাদ্রীদের কুসংস্কার ও মিথ্যার ভিত। যে সব পুরুষকে বাগে আনার জন্যে তাকে তৈরী করা হয়েছিল সেইসব দুর্নীতিবাজ কাপুরুষদের প্রতি ঘৃণায় তার হৃদয়ে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। এসব অপকর্মের হোতাদের চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার আগুন জ্বলতে থাকে তার কোমল হৃদয়ে। কিন্তু করার কিছুই নেই তার। সে যে বাধা কুশের অক্টোপাসে। মিথ্যার জাল ছিন্ন করে পাপাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর সামর্থ নেই তার, পাপ জগৎকে সে কিভাবে নির্মূল করবে? জানালার পাশে বসে উথাল-পাতাল চিন্তার কুল-কিনারা পাচ্ছিল না তরুণী। চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। পাপ জগৎ থেকে বাঁচার অথবা পালিয়ে যাওয়ার কোন পথই দেখছিল না সে।
জেগে উঠল বড় তরুণী। সঙ্গিনীকে জানালার পাশে বসা দেখে কাছে গিয়ে বসল। চোখে অশ্রু দেখে বলল, ভাই! প্রাথমিক পর্যায়ে আবেগ-অনুভূতি এমনই হয়ে থাকে। ভেবে দেখো, আমরা যা কিছু করছি, তা আমাদের জীবন সুখের জন্যে নয়, সাধ মিটানোর প্রয়োজনেও নয়, যিশুখৃস্টের মর্যাদা রক্ষার জন্যে করছি। ইসলামকে ধ্বংস করে ক্রুশের আদর্শ প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রাখো, তাহলে আর দুঃখ থাকবে না। দেখো, আমাদের সৈনিক রণাঙ্গনে লড়ছে, আর আমরা রণাঙ্গনের বাইরে প্রাসাদের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করছি, এখানে আমাদের ক্ষেত্র হচ্ছে, মুসলমান নেতাদের প্রাসাদ, আমাদের টার্গেট ওদের মাথা, আর আমাদের অস্ত্র আমাদের দেহ-রূপ। ভাই! দেহের চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলো, এটা কিছু না, তুমি যে মিশন পালন করছে তাতে তোমার অন্তর সম্পূর্ণ পবিত্র।
আমরা ক্রুশের জন্যে আমাদের দেহমন পণ্যে পরিণত করি, কিন্তু মুসলমানরা একাজে তাদের নারীদের ব্যবহার করে না কেন? আমাদের শাসক ও সৈনিকেরা মুসলমান শাসক ও সৈনিকদের মতো রণাঙ্গনে বীরত্ব দেখাতে পারে না কেন? চোরের মতো মুসলিম নেতাদেরকে হত্যা করতে কেন গোপনে চক্রান্ত করে? আইয়ূবীর এই গোয়েন্দাদের মতো আমাদের গোয়েন্দা ও সৈন্যরা কেন সাহসী হতে পারে না? আমাদের শাসক ও সৈন্যরা সাহসী হতে পারে না আত্মদুর্বলতার কারণে। মিথ্যাবাদী ও অন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারীরা কখনও সাহসী হতে পারে না, এরা কাপুরুষ। কাপুরুষ বলেই আড়ালে আবডালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। বলল ছোট তরুণী।