* * *
ঈসিয়াত দুর্গ ছিল বর্তমান লেবানন সীমান্তে। হাসান বিন সাবাহর উত্তরসূরী শেখ সিনানের রাজত্ব ছিল সেই দুর্গে। এদেরকে দুর্গসহ সামগ্রিক সহযোগিতা দিয়েছিল খৃস্টান শাসকরা। এরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করতো, কিন্তু সত্যিকার ইসলামের অনুসারী ছিল না এরা। মূলত মাদক ও নেশার চর্চা করে এরা মানুষকে ধোকা দিত, হত্যা করত। শেষ পর্যায়ে ভাড়াটে খুনী গোষ্ঠীরূপেই পরিণত হয় সাবাহ গোষ্ঠী। অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন খৃস্টান নেতাকেও হত্যা করিয়েছিল শেখ সিনান। মুসলমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করা ছিল এদের অন্যতম টার্গেট। এ টার্গেটের জন্য আরো কয়েকটি ছোট ছোট দুর্গও অস্ত্রশস্ত্র শেখ সিনানকে দিয়েছিল খৃস্টানরা। খৃস্টানদের অর্থের লোভে এরা নূর উদ্দীন জঙ্গী ও আইয়ূবী হত্যার চেষ্টায় মেতে উঠে। নূরউদ্দীন জঙ্গীকে শেখ সিনানের লোকেরাই হাশীশ খাইয়ে হত্যা করেছিল বলে মনে করেন কোন কোন ঐতিহাসিক। হাশীশ খাওয়ার কারণেই অসুস্থ হয়ে জঙ্গী কয়েক দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। এরপর শুরু হয় আইয়ূবীকে হত্যার নীলনক্সা। এ নীলনক্সা প্রণীত হয় হাশীশ ও ইহুদী-খৃস্ট গোষ্ঠীর যোগসাজসে। এদেরই ফসল দুই তরুণী যখন নাসের ও তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঈসিয়াত দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছাল তখনও ভোরের সূর্য উঠতে ঢের বাকী। বড় তরুণী ঘোড়া থেকে নেমে সাংকেতিক শব্দে কি যেন বলল দ্বাররক্ষীদের, একটু পরেই খুলে গেল ফটক, তরুণী সবাইকে নিয়ে প্রবেশ করল দুর্গে। নাসের ও সাথীদেরকে এক অফিসারের কাছে সোপর্দ করে শেখ সিনানের কাছে চলে গেল দুই তরুণী।
শেখ সিনান নিজেকে রাজা ভাবতো। রাজা ভাবার মতো সামগ্রিক অবস্থাও ছিল তার। কিন্তু বয়সের আধিক্যে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ও চুল দাড়ি সাদা হয়ে গেলেও নিজেকে বুড়ো ভাবতে পারতো না সিনান। বড় তরুণী যখন শেখ সিনানের কাছে তার দোস্ত সাইফুদ্দীনের পরাজয় এবং তাদের পলায়নের বর্ণনা দিচ্ছিল তখন ছোট তরুণীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিনান।
এদিকে এসো! বড় তরুণী থেকে মনোযোগ সরিয়ে ছোট তরুণীকে আহবান করল সিনান। তুমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশী সুন্দরী। আমার কাছে বসো। তরুণীকে বোগলদাবা করে তার রেশমী চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সিনান বলল, তোমরা ক্লান্ত। আজ আমার এখানেই রাত যাপন করবে।
শেখ সিনানকে ইতোপূর্বে দেখেনি ছোট তরুণী। সে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল সিনানের দিকে। এরপর ভেংচি দিয়ে দূরে সরে এলো। এই বুড়োর ন্যাকামী ভাল লাগল না তার।
হেচকা টান দিয়ে তরুণীকে কোলের উপর ফেলে দিল সিনান। ওর বক্র চাউনীতে অপমানিত বোধ করল বুড়ো। বড় তরণীকে বলল, ওকে মনে হয় আমার সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। আমার প্রতি বিদ্রূপ কতটুকু অপরাধ তা বোধ হয় ও জানে না।
আমি আপনার কেনা বাদী নই। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল ছোট তরুণী। আমার কর্তব্যের মধ্যেও এটা পড়ে না যে, যেই আমাকে কোলে টেনে নিবে আমি ওর হাতে নিজেকে সঁপে দেবো। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল সে। বলল, আমি ক্রুশের দাসী বটে হাশীশদের কেনা বাদী নই।
বড় তরুণী তাকে ধমক দিয়ে চুপ হতে বলল, কিন্তু তরুণী বলতে লাগল, মুসলমানদের হেরেমে এ লোক আমাকে দেখেনি। আমি কর্তব্য পালন ছাড়া ওখানে কোন অপরাধ করিনি। বুড়োর বিনোদনের পাত্রী হওয়া আমার কর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়।
তুমি এতো সুন্দরী না হলে তোমার অপরাধ ক্ষমাযোগ্য ছিল না। বড় তরুণীকে নির্দেশের সুরে বলল, ওকে নিয়ে যাও। ঈসিয়াত দুর্গের আদব ওকে শিখিয়ে দিও।
ছোট তরুণীকে বাইরে রেখে এসে আবার শেখ সিনানের কামরায় ঢুকল বড় তরুণী। বলল–আপনার ক্ষোভ যথার্থ কিন্তু কর্তাদের হুকুম ছাড়া যে কারো আবদার আমরা রক্ষা করতে পারি না। আমি যেহেতু আপনাকে জানি এবং এ দুর্গে ইতোপূর্বেও এসেছি, এজন্য আপনার কাজের প্রয়োজনে চারজনকে ফাঁসিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। এদিকে আপনার দৃষ্টি দেয়া দরকার। সে নাসের ও সাথীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলল।
ঠিক আছে, ওই চারজনকে ব্যবহার করব আমি। এটা একটা ভাল কাজ করেছ। কিন্তু এই মেয়েকে আমার কামরায় অবশ্যই রাখবো।
এ কাজ আমার উপর ছেড়ে দিন। ও তো আর এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না। আমি ওকে আপনার কাছে আসার জন্যে রাজী করাব। সে খুশী মনে আপনার কাছে চলে আসবে। আসবে, অবশ্যই আসবে…..!
* * *
নাসের ও তার সাথীদেরকে শেখ সিনানের দুই লোক একটি কক্ষে নিয়ে গেল। নেশার ঘোরে সারারাত বিরামহীন পথ চলেছে এরা, নেশার ঘোর না কাটলেও তাদের দেহ অবসন্ন। কক্ষের মধ্যে সুসজ্জিত বিছানা। ওরা বিছানায় গা এলিয়ে দিলে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল। অপর দিকে তরুণী দুজনও সারা রাত নিঘুম কাটিয়েছে। তাদের জন্যে বরাদ্দ কক্ষে গিয়ে তারাও ঘুমিয়ে পড়ল…।
দুপুরে চোখ খুলল নাসের। চোখ মেলেই তাকাল চারপাশে। সাথীরা তখনও ঘুমে অচেতন। চারদিক বুঝতে চেষ্টা করল নাসের। চারদিকে শ্যামল সবুজের সমারোহ নেই, নেই ফুলে ফুলে ভরা অনিন্দ বাগান। পাখ-পাখালীর কল-কাকলীও নেই। নেই ভ্রমরের গুঞ্জন। পায়ের নীচে মখমলের মতো নরম ঘাসও নেই। তার মনে পড়ল সেই স্বপ্নময় চিত্র। স্মৃতিতে ভাসতে থাকল জান্নাতি দুই সুন্দরী, ফুল, পাখি ঝর্ণা। মনে পড়ল দীর্ঘ মরু সফর, কষ্ট, ক্ষুধা তৃষ্ণা, মনে পড়ল সবই। সবকিছু তার স্মৃতিতে পরিষ্কার। কিন্তু এখন সে কোথায়? এটাতো একটা সাজানো গোছানো কামরা। এখানে কয়েকটি বিছানা, সাথীরা বিছানায় অঘোরে ঘুমুচ্ছে। স্বপ্নময় চিত্র, মরু কষ্ট ও দুই তরুণীর কথা মনে পড়ল। কিন্তু এখন কোথায় আমি? এ চিন্তা ভাবিয়ে তুলল নাসেরকে।