সাইফুদ্দীনের পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী তখন ওর রক্ষিতা মেয়েরা হয়ে উঠল বোঝার উপর শাকের আঁটি। সাইফুদ্দীন সব ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। খৃস্টানদের জন্যে এই প্রশিক্ষিত মেয়ে দুটি ছিল দামী অস্ত্র। ওরা এদের উদ্ধার করতে দুটি ঘোড়া, খাবার পানি, আহার এবং তাদের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হাশীশ ও গন্ধহীন নেশাদ্রব্য বেঁধে দিল ঘোড়ার পিঠে। দিয়ে বলল, তোমরা এ পথ ধরে ঈসিয়াত দুর্গে চলে যাবে। খঞ্জর দেয়া হল এদের হাতে। যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে আত্মরক্ষায় ব্যবহার করতে পারে। এসব গোয়েন্দা মেয়েকে অস্ত্র চালনা, অশ্বারোহণ এবং মাদকদ্রব্য খাইয়ে মানুষকে ধোকা দেয়ার কৌশল পুরো মাত্রায় শেখানো হতো। সাইফুদ্দীনের বাহিনী যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, সৈন্যদের মধ্যে আত্মরক্ষা ও পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল তখন দুজন শক্তিশালী যোদ্ধা এদেরকে তুর্কমানের যুদ্ধ এলাকা পার করে দিয়ে ঈসিয়াতের পথ ধরিয়ে দিল। বড় মেয়েটি ছিল দুর্দান্ত সাহসী ও অভিজ্ঞ। দিনের বেলায় সঙ্গীকে নিয়ে ঈসিয়াত দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে থাকল সে। কিন্তু পথ ছিল দুর্গম আর মরুভূমির প্রচণ্ড তাপদাহ। দুপুর পর্যন্ত চলার পর একটি টিলার গায়ে ছায়া দেখে ওখানে ঘোড়া থামিয়ে আহারাদি সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিল এরা। এমন সময় তাদের সামনে এলো নাসেরের কাফেলা।
নাসেরও সাথীদের দেখেই বড় তরুণী বুঝে নিয়ে ছিল এরা কারা হতে পারে। তাই তাদেরকে পানি পান করিয়ে তারপর খাবারের সাথে হাশীশ খাইয়ে দিল। এরপর ওদের সাথে জিনের অভিনয় করে ভড়কে দিল এবং বিশ্বাস জন্মাল সত্যিই তারা জিন। নাসের ও সাথীরা ঘুম থেকে উঠার পর আবার ওদেরকে পানির সাথে গন্ধহীন নেশা ও হাশীশ খাওয়াল। সেই সাথে কৌশলী অভিনয় করে ওদের দেমাগকে এভাবে কজা করল যে ওরা তাদের জিন ভেবে আত্মসমর্পণ করে, পরিত্রাণের আবেদন করে বসল তরুণীদের কাছে। এই সুযোগে ওদেরকে নিরাপত্তা সহযোগী বানিয়ে তরণীদ্বয় নির্ভয়ে চলে গেল ঈসিয়াত দুর্গে।
তরুণীদের মাদক প্রয়োগ ও চার যোদ্ধাকে জিন ও বেহেশতের স্বপ্নচিত্রের মুগ্ধতায় বোধহীন করার কৌশল ছিল শেখ সিনানের শেখানো। শেখ সিনান মানুষদেরকে মাদকদ্রব্য খাইয়ে স্বপ্নময় ভুবনের কল্পনায় ভুলিয়ে দিয়ে নিজের কাজ উদ্ধার করতো। শেখ সিনানের কৌশলের উদ্ভাবক ছিল হাসান বিন সাবাহ। হাসান বিন সাবাহ ইহুদী পণ্ডিতদের শীর্ষ পর্যায়ের একজন। সেই প্রথমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমরাস্ত্রের চেয়ে মাদক, নারী ও স্বপ্নকৌশল প্রয়োগের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। তারই স্থলাভিষিক্ত শেখ সিনান। শেখ সিনান ইহুদী ও খৃস্টানদের সহযোগিতায় ঈসিয়াত দুর্গে একটি শক্তিশালী বাহিনী তৈরী করেছিল। এদেরকে বলা হতো ফিদাঈ। শেখ সিনানের কাছে হাশীশ, মাদক প্রয়োগ ও কল্পচিত্র দিয়ে মানুষকে বাগে আনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বড় তরুণী।
তরুণীদ্বয় প্রথমে নাসের ও সাথীদের উপর মাদক ও কল্পকৌশল প্রয়োগ করে ওদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। যখন দেখল তার কৌশল শতভাগ সফল হচ্ছে; তখন এদেরকে শেখ সিনানের কাছে নিয়ে গেলে ওদের রণকৌশল ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে আইয়ূবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ হতে পারে বলে মনে করল। তরুণী জানতো, ইতোমধ্যে গোমশতগীন আইয়ূবীকে হত্যার জন্য শেখ সিনানের দারস্থ হয়েছে এবং তাকে মোটা মাপের সেলামী দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
* * *
তুর্কমানে মোজাফফর উদ্দীনের হামলা ব্যর্থ করে দিয়ে আইয়ূবী জেনারেলদের বললেন, এখন যুদ্ধ শেষ। তোমরা মালে গনীমত কুড়িয়ে জড় কর। মোজাফফর উদ্দীন ও সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনীর ফেলে যাওয়া মালে গনীমত ছিল বিপুল। সাইফুদ্দীনের তাঁবু থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা, অলংকার ও মণিমুক্তা পাওয়া গেল। অনেক অলংকার যোদ্ধাদের সাথেও ছিল। এছাড়া যুদ্ধাস্ত্র, আসবাবপত্রের পরিমাণ অপরিমেয়। আইয়ূবী যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন আর নগদ অর্থ ও অলংকারাদি মিশর ও সিরিয়ার যেসব নতুন এলাকা তার অধীনে যুক্ত হয়েছিল সেসব এলাকার গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এক তৃতীয়াংশ পাঠিয়ে দিলেন বাগদাদের নেজামিয়া মাদরাসায়। যেটি তকালের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ ছিল। আইয়ূবী মাদরাসায়ে নেজামিয়া থেকেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোলের ভাষায়, একথা প্রমাণিত যে, আইয়ূবী মালে গণীমত থেকে নিজে কিছুই রাখতেন না, সবই সেনাবাহিনী ও জনকল্যাণে খরচ করতেন।
বড় সমস্যা ছিল বহু সংখ্যক বন্দী শত্রুসেনার সুরাহা করা। আইয়ূবী তাদেরকে একত্রিত করে বললেন, তোমাদের শাসকরা ইসলামের চির শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে ওদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। তোমরা মুসলমান হয়েও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এজন্যই তোমাদের পরাজয় হয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ করে দিয়েছো তোমরা। তোমাদের অপরাধ ও গোনাহ ক্ষমা পাওয়ার একমাত্র পথ। হলো, ইসলামের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করা। এসো, আমরা সবাই মিলে বেঈমানদের কাছ থেকে প্রথম কিবলাকে উদ্ধার করি। আইয়ূবীর এই ভাষণ ছিল আবেগময় ও ঈমানদীপ্ত। বন্দী যোদ্ধারা আইয়ূবীর ভাষণে উদ্দীপ্ত হলো, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অধিকাংশই তাকবীর দিতে শুরু করল এবং নিজেদেরকে আইয়ূবীর বাহিনীতে ন্যস্ত করার আবেদন করল। আইয়ূবী তাদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত করে নিলেন। এতে তার বাহিনীতে প্রশিক্ষিত সৈন্য ও কমান্ডারের সংখ্যা বাড়ল। সৈন্য ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হল। তদুপরি আইয়ূবী অগ্রাভিযান মুলতবি করে দিলেন। নতুনভাবে সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানোর জন্যে দামেশক ও মিশর থেকে রসদপত্র আসার অপেক্ষা করলেন। মোজাফফর উদ্দীনের আক্রমণ আইয়ূবীর বাহিনীর কাঠামো অনেকটাই নড়বড়ে করে ফেলেছিল।