যে পুরুষ এক পত্নীতে বিশ্বাসী এবং জীবনভর এক পত্নীর অনুগত থাকে, এসব মানুষ আমার খুব ভাল লাগে। খৃস্ট ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরও আমার ইচ্ছে হয় যদি কোন মানুষকে প্রেমে আবদ্ধ করতে পারতাম, সে যদি আমার ভালবাসায় মুগ্ধ ও আমার অনুগত হতো তবে আমি তাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতাম। বলল ছোট তরুণী।
এসব আবেগ সিকেয় তুলে রাখ। ধমকের সুরে বলল বড় তরুণী। এসব ভুলে যে পবিত্র মিশনে এসেছে সেটি মাথায় রাখো। ভুলে যেয়ো না, তুমি কুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছো, যতো দিন জীবিত থাকবে ক্রুশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গীত রাখবে। জানি, মানুষের মধ্যে আবেগ আছে, আমাদেরকে আদর্শের প্রয়োজনে আবেগ পরিহার করতে হবে। ক্রুশ আমাদের এতটুকু ত্যাগ দাবী করে।
তরুণীদ্বয় কাফেলার আগে আগে যাচ্ছিল। নাসের ও সাথীরা একই কোরাস গুনগুনিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল নির্বিকার চিত্তে। যতোই রাত বাড়তে লাগল, ততই নিকটবর্তী হয়ে আসল তাদের নতুন ঠিকানা।
* * *
এই তরুণী দুটি কে? কি এদের পরিচয়। এ পর্যায়ে এদের পরিচয় জেনে নেয়া দরকার। খৃস্টান ও ইহুদী লোকেরা অতি শৈশবেই সুদর্শন মেয়ে শিশুদেরকে ধর্মের কাজে উৎসর্গ করাকে পুণ্যের কাজ মনে করে। ইহুদী-খৃস্টান পণ্ডিতেরা এদেরকে গীর্জার অধীনে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা বৃত্তি এবং শাসকদের আদর্শচ্যুত করতে ব্যবহার করে। এদেরকে শৈশব থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়, কিভাবে পুরুষদেরকে হাত করে তার ভিতর থেকে পরিকল্পনাগুলো বের করে আনা যায়। দৈহিক ও মানসিকভাবে এরা যে কোন পুরুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। ইহুদীরাই মেয়েশিশুদের বেশী উৎসর্গ করতো একাজে। অনেক সময় মুসলিম কাফেলা আক্রমণ করে শিশুদের অপহরণ করে ওদেরকে কৌশলে প্রয়োগ করা হতো এসব কাজে। ইহুদী-খৃস্টানদের এ ধারা বহু পুরানো এবং আজো এর প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে।
এই দুটি মেয়ে খৃস্টানরা উপহার দিয়েছিল মৌসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীনকে। মুসলিম মেয়েদের মধ্যে তখন এতোটা সৌন্দর্য চর্চা, ফিগার সচেতনতা ও যাদুকরী কথা বলার ঢং ও নাচ গানের চর্চা ছিল না। কিন্তু এই দুই তরুণী যেমন সুন্দরী, নাচে-গানে বাগ্মীতা ও রূপ ঢংয়ে যে কোন পুরুষের পৌরুষকে প্রথম দর্শনেই নাড়া দেয়ার মতো আকর্ষণীয়। এদেরকে পাঠানো হয়েছিল সুনির্দিষ্ট মিশনের দায়িত্ব দিয়ে। সাইফুদ্দীন যেমন ছিল ক্ষমতা লিন্দু, তেমনই নারী লোভী। আইয়ূবীর সাথে তার ছিল চির বৈরিতা। নূর উদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুতে গভর্নর থেকে নিজেকে স্বাধীন আমীর ঘোষণা করে ক্ষমতার মোহে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারে না। এই সুবাদে এগিয়ে এলো খৃস্টানরা। ওরা টোপ দিল আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর তাহলে তোমাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করব আমরা। তবুও ওদের আশংকা ছিল; কোন এক বাঁকে সাইফুদ্দীন যদি আইয়ূবীর সাথে সন্ধি করে বসে তবে খৃস্টানদের অনেক চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাবে। কিছুতেই যাতে সাইফুদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতা থেকে ফিরে আসতে না পারে এজন্যই পাঠানো হয়েছে উপঢৌকনের মোড়কে তরুণী গোয়েন্দা।
সাইফুদ্দীন সম্মিলিত তিন বাহিনীর চীপ কমান্ডার হয়ে যখন তুকমান ময়দানে আইয়ূবীর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে গেল তখন তার হেরেমের সুন্দরী নর্তকী, গায়িকা ও বিউটিশিয়ানদের সাথে নিয়ে গেল। এই তরুণী দুটি নিজের পরিচয় এভাবে আড়াল করে রেখেছিল যে, সাইফুদ্দীন এদেরকে ভেবে ছিল মুসলমান। এদেরও সাথে নিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। এরা তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে নাচ, গান, শয্যাসঙ্গিনী হতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতো না। বরং পুরুষের দুর্বলতম মুহূর্তগুলোতে ওদের গোপন পরিকল্পনা যেমন এরা বের করে আনতো অনুরূপ নিজেদের মিশনের পক্ষে শাসকদের দেমাগকে এরা বদলে দিতে সক্ষম হতো। সবই এরা করতো বাকপটুতায় ও আকর্ষণীয়া রূপে নিজেদের উপস্থাপন করে, ভোগ্যরূপে নিজেরে মেলে ধরে।
বড় তরুণীটি কয়েক দিনের মধ্যেই সাইফুদ্দীনের মন জয় করতে সক্ষম হয়। সাইফুদ্দীন হেরেমের সবার উপরে ওকে গুরুত্ব দেয়। যে কোন জটিল ও গোপন বিষয়েও ওর উপস্থিতিকে সাইফুদ্দীন নিঃশঙ্ক মনে করে। ওর যাদুকরী কথা ও অঙ্গভঙ্গি সাইফুদ্দীনের দিল দেমাগে প্রাধান্য বিস্তার করে নেয়।
সাইফুদ্দীন যুদ্ধ ময়দানকেও তার প্রাসাদে রূপান্তরিত করেছিল। আরাম আয়েশ আমোদ-সূর্তির সব উপাদানই সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। বিশাল সৈন্যবল ও রসদের প্রাচুর্যতার কারণে তার আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। তার বিপুল বাহিনী আইয়ূবীর সৈন্যদেরকে মেষ শাবকের মতো তাড়িয়ে মারবে এটাই ভেবেছিল সাইফুদ্দীন। কিন্তু বিধি বাম। মরু ঝড়ের মধ্য দিয়ে ফৌজি তার ভাবী ও ভাইকে নিয়ে গেল আইয়ূবীর শিবিরে। বলল, তিন বাহিনী আইয়ূবীর বিরুদ্ধে ধেয়ে আসছে। খবর পেয়েই প্রস্তুতি নিলেন আইয়ূবী। সাইফুদ্দীনের অজ্ঞাতে আক্রমণ করে ওদের দর্পচূর্ণ করে দিলেন।
এমতাবস্থায়ও এই দুই তরুণী সর্বক্ষণ থাকতো সাইফুদ্দীনের কাছে। তিন বাহিনীর মধ্যে বহু উঁচু অফিসার ছিল খৃস্টানদের এজেন্ট। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে এরা। তথ্য ও সংবাদ পাচার করলে ওরা ঠিক সময় মতো পৌঁছে দিতো খৃস্টান কর্তাদের কাছে।