সাইফুদ্দীন ছিল মৌসুল শহর ও তদঞ্চলের গভর্নর। একটি সামরিক ইউনিটের সেনাধ্যক্ষও ছিল সে। রণকৌশলে তার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। কিন্তু সাইফুদ্দীন ছিল স্বভাবে উগ্র, হাঙ্গামা প্রিয়, ক্ষমতা লিলু। ক্ষমতার মোহে ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিল খ্রিস্টানদের কাছে। যে ঈমান শুধু মুসলমানদের বিশ্বাসগত বিষয় নয়, যুদ্ধের ময়দানে ঈমানের শক্তিই মুজাহিদদের ঢাল তরবারীর মূল রক্ষাকবচ।
যুদ্ধের ময়দানেও সাইফুদ্দীন বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করতে পারেনি। হেরেমের সুন্দরী নারী, সেবিকা, দাসী ও নর্তকীদের নিয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে কাড়ি কাড়ি মদের মটকি, নাচ-গানের সরঞ্জামাদি আর বাহারী পাখি। কিন্তু হতভাগা সবকিছু রণাঙ্গনে ফেলেই জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। যাওয়ার কথা ছিল মৌসুল কিন্তু আইয়ূবীর পশ্চাদ্ধাবনের ভয়ে বিক্ষিপ্ত পলায়নপর সৈনিকদের মতো সে মৌসুলের পথে না গিয়ে বিজন এলাকা দিয়ে তার ডিপুটি ও এক কমান্ডারকে সাথে নিয়ে অন্যদিকে রওয়ানা হল।
পলায়নপর সাইফুদ্দীন ও সাথীরা হয়তো সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কমান্ডোদের দেখতে পেয়েছিল, তাই তারা মৌসুলের পথ ছেড়ে বিপথে রওয়ানা হল। সে সময়কার পরিবেশ ছিল পলায়ন ও লুকিয়ে থাকার উপযোগী। অসংখ্য, মরুটিলা, বালিয়াড়ী, ঝোঁপঝাড়, গাছপালা আর বিজন প্রান্তর ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। এরা এসব অনাবাদী পথেই ঘোড়া হাঁকাল। রাতের আঁধারে পালাতে পালাতে মৌসুলের কাছেই পৌঁছে গেল সাইফুদ্দীন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, ভীত সাইফুদ্দীন ও সাথীরা চাঁদনী রাতের আলোতে একটি পল্লী দেখতে পেল। পল্লীর প্রথম বাড়িতে গিয়ে একটি ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। আরোহীরা হাঁপাচ্ছিল। বৃদ্ধ তাদের দেখে বললেন, মনে হয় তোমরা মৌসুলের সৈনিক। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছ। দুদিন ধরেই দেখছি সৈনিকেরা পালিয়ে আসছে। এখানে এসে তারা ঘোড়া থামিয়ে পানি পান করে মৌসুলের দিকে চলে যাচ্ছে।
এখান থেকে মৌসুল কত দূর? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।
তোমাদের ঘোড়া যদি চলতে পারে তবে সকাল পর্যন্ত তোমরা মৌসুল পৌঁছে যেতে পারবে। এ গ্রামটি মৌসুলের অধীনে পড়েছে।
তোমার এখানে যদি জায়গা থাকে তবে কি আমরা রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি? অনুরোধের স্বরে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।
জায়গা শুধু থাকলেই হয় না, পথিকের আশ্রয় করে দেয়া হৃদয়ের ব্যাপার। তোমরা ঘোড়া থেকে নেমে ভিতরে এসো।
বৃদ্ধ একটি ঘরে নিয়ে বসাল তাদের। বাতির আলোতে বৃদ্ধ পরখ করল তাদের পোষাক।
তুমি কি আমাদের চেনার চেষ্টা করছো? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।
দেখে মনে হচ্ছে তোমরা সাধারণ সৈনিক নও। তোমাদের মর্যাদা হয়তো সেনাপতি পর্যায়ের হতে পারে। বলল বৃদ্ধ।
ইনি মৌসুলের গভর্নর গাজী সাইফুদ্দীন। বলল সাইফুদ্দীনের ডিপুটি। তুমি কোন সাধারণ মানুষকে আশ্রয় দাওনি। এজন্য তুমি অনেক পুরস্কার পাবে। আর আমি ডিপুটি গভর্নর। সে একজন কমান্ডার।
একটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুন বুড়ো। বলল সাইফুদ্দীন। তোমার বাড়িতে আমাদের একাধিক দিনও থাকতে হতে পারে। আমরা দিনের বেলায় ঘর থেকে বের হব না। আমরা যে এখানে আছি একথা কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। একথা যদি বাইরে প্রকাশ পায় তবে কিন্তু তোমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আমাদের অবস্থানের ব্যাপারটি চেপে রাখলে তোমাকে বহু। ইনাম দেয়া হবে। তুমি যা চাইবে তাই দেয়া হবে।
আমি মৌসুলের গভর্নরকে আশ্রয় দিচ্ছি না। তোমরা হয়তো ভুলে গেছো যে, তোমরা এখন আমার এখানে বিপদগ্রস্ত আশ্রয়প্রার্থী। আশ্রয়প্রার্থী যেই হোক, তাকে আশ্রয় দেয়া আমার কর্তব্য। তোমাদের যতদিন ইচ্ছা থাকো, সাধ্যমতো আমি তোমাদের খেদমত করার চেষ্টা করব। তোমরা লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করলে লুকিয়েই রাখব। তোমাদের প্রতি আমার বেশী আগ্রহের কারণ হলো, আমার ছেলে মৌসুল সেনাবাহিনীতে চাকরী করে।
আমরা তাকে প্রমোশন দিয়ে দেবো। বলল ডিপুটি।
তোমরা যদি তাকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করো সেটিই হবে আমার জন্য বড় পুরস্কার।
এ্যাঁ! একি বললে বুড়ো? প্রত্যেক বাবাই চায় তার ছেলের পদোন্নতি হোক। বলল সাইফুদ্দীন।
না। আমি তার বেঁচে থাকার আশাও কখনো করিনি। আমি জাতীয় সেনাবাহিনীতে তাকে পাঠিয়ে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছিলাম। আমিও একদিন সৈনিক ছিলাম। তখন হয়তো তোমাদের জন্মই হয়নি। আমি তোমাদের বাবা কুতুবুদ্দীনের অধীনে যুদ্ধ করেছি। আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। আমরা যুদ্ধ করেছি কাফেরদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তোমরা আমার ছেলেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। আমি তার মৃত্যু নয় শাহাদত কামনা করেছিলাম।
সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী নামে মুসলমান। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয। শুধু জায়েয বললে যথার্থ হয় না বরঞ্চ ফরয। বলল সাইফুদ্দীন।
বুড়ো, তুমি এসব বুঝবে না। কে মুসলমান আর কে কাফের এসব ব্যাপার আমরা বুঝি। বলল ডিপুটি।
মিয়ারা! তোমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ। আমার বয়স এখন পঁচাত্তর। আমার বাবা নব্বই বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তার বাবা পঞ্চাশ বছর বয়সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। দাদা জিহাদের কাহিনী আমার বাবাকে শোনাতেন। আমরা বাবার কাছ থেকে শুনেছি। এর উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি, আমি যা জানি তোমরা তা জান না। ক্ষমতা আর রাজত্বের লোভে যারাই ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে একদিন না একদিন আমার মতো গরীবের পর্ণকুঠিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তোমাদের আগে যারা পালিয়ে এসেছে, তাদের অবস্থাও তোমাদের মতোই। তোমাদেরকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর একজন মাত্র সৈনিক তাড়িয়ে এনেছে। দুদিন ধরে আমি এই তামাশাই দেখছি। তোমরা দশজন হলেও ওই একজনের ভয়ে এভাবেই পালাতে। সত্যের উপর যারা থাকে তাদের আত্মবল এমনি হয়। ওরা একা দশজনকে ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে নিতে পারে। আর সত্যের সৈনিক কখনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায় না। রণাঙ্গন থেকে তার লাশ উঠিয়ে আনতে হয়।