* * *
ওদের জাগিয়ে দাও। বলল বড় তরুণী। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে।
আমাদেরকে কি পথে ফেলে চলে যাবে? জিজ্ঞেস করল নাসের।
তোমরা আমাদের সাথেই যাবে। আমাদের ছাড়া তোমরা যেতে পারবে না। বলল বড় তরুণী।
সাথীদের জাগাল নাসের। ছোট তরুণীকে কি যেন বলল বড় তরুণী। সে ঘোড়ার পিঠে বাঁধা পুটলী থেকে একটি পুটলীর মতো নিয়ে এলো। মশক খুলে সেখানে ঢেলে দিল পুটলীর বস্তু। কিছুক্ষণ নাড়িয়ে মশকটি বাড়িয়ে দিল বড় তরুণী নাসেরের দিকে। বলল, এই পানিটুকু সবাই মিলে পান করে নাও। পথে হয়তো আর পানি পাওয়া যাবে না।
নাসের ও সাথীরা সাগ্রহে পান করল পানিটুকু। ওদেরকে আবারো কিছু আহার দিল বড় তরুণী। সেই খাবারও খেয়ে নিল নাসের ও তার সাথীরা। কিছুক্ষণ পর মশক ও পুটলী ঘোড়ার পিঠে রাখল তরুণী। তখন সূর্য ডুবে গেছে প্রায়।
হু, তোমরা এ জায়গাটিকে বলছো, জাহান্নাম। আমি তো এখানে সবুজ আর সবুজ দেখছি। এতো অল্প সময়ে এখানে আমাদের তোমরা কিভাবে নিয়ে এলে? উচ্চকণ্ঠে বলল নাসের। নাসেরের সাথীরাও অবাক বিস্ময়ে দেখছিল চতুর্দিক।
তোমরাও কি সবুজের সমারোহ দেখতে পাচ্ছো? নাসেরের সহযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করল তরুণী।
আরে! আমরা তো বসেই আছি সবুজ ঘাসের উপর। বলল অপর একজন।
আচ্ছা, তোমরা আমাদের হত্যা করবে না তো? জিজ্ঞেস করল অপর একজন। কারণ তোমরা তো জিন।
না, তোমাদের হত্যা করব কেন? এর চেয়েও আরো সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাদের।
বড় তরুণী নাসের ও তার এক সাথীকে তার দুপাশে বসিয়ে দুজনের কাঁধে দুহাত প্রসারিত করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও। অপর তরুণীও বাকী দুইজনকে একই রূপে নিজের পাশে বসিয়ে দুহাত ওদের কাঁধে দিয়ে চোখে চোখ রাখতে বলল। দুর্ধর্ষ এই চার গোয়েন্দার কানে গুঞ্জরিত হল বড় তরুণীর কণ্ঠ–এটাই তোমাদের বেহেশত। দেখো, সুন্দর ফুলের বাগান, সবুজের সমারোহ। তাজা ফুলের সুবাস নাও। দেখো, বাগানে কতো সুন্দর পাখি উড়ছে। এটা তোমাদের পুরস্কার। তোমাদের পায়ের নীচে মখমলের গালিচার মতো নরম কোমল তাজা ঘাস। দেখো! কতো সুন্দর ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে, স্ফটিক স্বচ্ছ ঝর্ণার পানি দারুণ মিষ্টি।
তরুণীর যাদুমাখা কথা চার যোদ্ধার দেহমনকে স্বপ্নিল জগতে ভাসিয়ে দিল। তারা বাস্তবতা ভুলে সম্পূর্ণ কাল্পনিক জগতে হারিয়ে দিল নিজেদের। হাসান বিন আব্দুল্লাহর সাথে সাক্ষাতের পর নাসের বলেছিল, তরুণীদ্বয় যখন ওদের চোখে চোখ রাখতে বলল আমাদের, আমরা সবাই ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বড় তরুণী বলতে লাগল কাল্পনিক দৃশ্য। আর আমরা বাস্তবতা ভুলে তলিয়ে গেলাম স্বপ্নিল জগতে। ওদের রেশমী চুলগুলোকে মনে হচ্ছিল সদ্যফোঁটা ফুলভর্তি লতাগুল্ম। ওদের চোখ দুটোই ছিল প্রবাহিত ঝর্ণা। মনে হচ্ছিল আমরা বসে আছি কার্পেটের মতো ঘন ঘাসের উপর। চতুর্দিকে সবুজ আর সবুজ। সুদৃশ্য বাগান। বাগানে পাখ-পাখালীর উড়াউড়ি কিচির-মিচির, কল-কাকলী। সত্যিই সেই স্বপ্নিল দৃশ্য যে কতো সুন্দর ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
* * *
হাঁটছিল ওরা। হাঁটছিল যেন মখমলের মতো তাজা ঘাসের উপর দিয়ে। অথচ ওখানে ছিল না ঘাসের কোন চিহ্ন, সবুজের অস্তিত্ব। তবুও ওদের কাছে মনে হচ্ছিল; ওরা হেঁটে যাচ্ছে ঘন সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে দারুন সুন্দর বাগানের ভিতরে। অথচ বাস্তবে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল রুক্ষ কঠিন বালিয়াড়ী আর শুষ্ক যমীন পেরিয়ে। ওরা চারজন যাচ্ছিল আগে আগে হেঁটে, আর তরুণীদ্বয় ওদের পিছনে আসছিল অশ্বারোহণ করে। তাদের প্রত্যাশা ছিল সুলতান আইয়ূবীর ছাউনীতে তুর্কমানে পৌঁছা কিন্তু তারা অগ্রসর হচ্ছিল সম্পূর্ণ উল্টো দিকে, হাশীশ সম্রাট শেখ সিনানের দুর্গে। আসলে তাদের তখন কোন বোধ ছিল না, নেশাদ্রব্য খাইয়ে বোধশক্তি লোপ করে ফেলেছিল দুই তরুণী। তারা অবোধের মতো ওদের নির্দেশ মেনে অগ্রসর হচ্ছিল বন্দীশালার দিকে।
তাদের পিছনে দুই তরুণী ওদের মিশন ও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে কথা বলছিল কিন্তু ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না এরা। এমতাবস্থায় সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমে এলো।
তুমি বললে রাত কোথাও থামবে না। এরা কি সারা রাত চলতে পারবে? বড় তরুণীকে জিজ্ঞেস করল ওর সাথী।
পানিতে যে পরিমাণ হাশীশ তুমি ওদের গিলিয়েছো, এর প্রভাব আগামীকাল সকাল পর্যন্ত থাকবে। আর আমি যা খাইয়েছি তা তো দেখলেই। ওদের ব্যাপারে নিঃশঙ্ক থাকতে পারো তুমি। আগামী দিনে বেলা উঠার আগেই আমরা ঈসিয়াত দুর্গে পৌঁছে যাব।
ওদের দেখে আমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। বলল ছোট তরুণী। সত্যিই যাদু জান তুমি। যেভাবে জিনের কথা বলে ওদের কাবু করলে, তা দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। মুসলমানরা কি জিনকে খুব বিশ্বাস করে?
জিন-ভূত কিছুই না। এসব বুদ্ধির খেলা। আমি ওদের বোধকে কজা করেছি। ওদের দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওরা আইয়ূবীর সৈনিক। ওদের চেহারা দেখে আন্দাজ করতেও আমার কষ্ট হয়নি, পথ হারিয়ে মরিয়া হয়ে পড়েছে ওরা। ওদের দৃষ্টিই আমাকে বলছিল, আমাদের চেয়ে ওরা বেশী ভয় পেয়েছে বিজন প্রান্তরে আমাদেরকে দেখে। ওদের দেখে যদি আমরা ভয়ে অবলা নারীদের মতো ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে আত্মসমর্পণ করতাম, তাহলে ওরা আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করতো; তা তুমি সারা জীবনেও ভুলতে পারতে না। এমন বিজন মরুতে আমাদের মতো তরুণী বাগে পেলে কোন পুরুষই কন্যা, ভগ্নির মতো সসম্মানে মাথায় রাখবে না। ওদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং জিন সম্পর্কে ওদের ভৌতিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েছি আমি। জিন সম্পর্কে ওদের ভৌতিক বিশ্বাস সম্পর্কে আমি জানতাম। সেই সুবাদে নিজেকে জিন বানিয়ে ফেললাম। এমন মরু বিয়াবানে আমাদের মতো সুন্দরী মেয়েদের অস্তিত্ব এরা বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমাদেরকে দেখে ওরা কল্পনা মনে করছিল অথবা ভাবছিল আমরা জিন-পরি। আমি ওদের সাথে এমনভাবেই কথা বলেছি যে, ওরা আমাদেরকে জিন মনে করেছে। ভাই! তুমি এখনও অনেক কাঁচ। আরো অনেক কিছু শেখার আছে এ পথে। দেখনি, সাইফুদ্দীনের মতো সিংহকে আমি আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়ে ছেড়েছি, আর ওরাতো সাধারণ সৈনিক।