আইয়ূবীর জন্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি হয়ে উঠল খুব সঙ্গীন। তিনি দূতদেরকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, রিজার্ভ বাহিনীকে বলো পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে।
ডানবাহুকে সুলতান যেভাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন তা তেমন কোন কাজে আসলো না। কারণ, মোজাফফর উদ্দীন সুলতানের চালকে রোধ করে দিচ্ছিল তারই কৌশলে। মোজাফফর উদ্দীনের দুর্বলতা এতটুকুই ছিল যে, তার সাহায্যকারী সৈন্যবলের ঘাটতি ছিল। সুলতান দূতদের মাধ্যমে ডানবাহুকে বিক্ষিপ্ত হতে নির্দেশ দিলেন। তার রিজার্ভ বাহিনীর পশ্চাতের আক্রমণে মোজাফফর উদ্দীনের রক্ষণভাগ খালি হয়ে গেল। তার নিজের নিরাপত্তাই হুমকির মুখোমুখি হল কিন্তু সে তখনও পালানোর চিন্তা করল না। অটল অবিচল থেকে মরণপণ লড়াই শুরু করল। দিনের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লড়াই এমন তীব্র আকার ধারণ করল যে, উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা জীবিতদের চেয়ে বেড়ে গেল। যুদ্ধে মোজাফফর উদ্দীন এমন কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে, আইয়ূবী বারবার চাল বদলাতে বাধ্য হচ্ছিলেন। সুলতান আইয়ূবী বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, মোজাফফর উদ্দীনের মতো ব্যক্তিই পারে এমন কঠিন মোকাবেলা করতে। শেষ পর্যন্ত উস্তাদের আখেরী চালে যদিও মোজাফফর উদ্দীন পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু আইয়ূবীকে সেদিন স্মরণীয় প্রতিপক্ষের মুখোমুখি ঘামঝরা লড়াইয়ে বহু প্রাণের বিনিময়ে বিজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল।
একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আইয়ূবী সুইসাইড স্কোয়াড ব্যবহার করলেন। ওরা জীবনপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার মোজাফফর উদ্দীনের রক্ষণভাগ ভেঙে পড়ল, সে রণে ভঙ্গ দেয়াকেই ভাল মনে করে পশ্চাৎপসারণ করল। বহু সংখ্যক শত্রু সৈন্য গ্রেফতার হলো সুলতানের হাতে। বন্দীদের অন্যতম ছিল মোজাফফর উদ্দীনের উপদেষ্ট ফখরুদ্দীন। ফখরুদ্দীন ছিল সাইফুদ্দীনের উজীর। সাইফুদ্দীনের পরাজয়ের পর সে আশ্রয় নিয়েছিল মোজাফফর উদ্দীনের কাছে। তাকে প্ররোচিত করেছিল সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
সময়টা ছিল ১১৭৬ সালের পয়লা এপ্রিল। মোজাফফর উদ্দীনের পরাজয়ে আইয়ূবীর জ্ঞাতি শত্রুদের কোমড় ভেঙে গিয়েছিল বটে কিন্তু এ বিজয়ের মূল্য এতো বিপুল রক্ত ও জীবন সম্পদ দিয়ে দিতে হয়েছিল যে, দুমাসের আগে আইয়ূবী তুর্কমান ত্যাগ করতে পারলেন না।
আইয়ূবীর ডানবাহুর অধিকাংশ সৈন্য আহত ও নিহত হয়েছিল। তার প্রধান শক্তিই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেকে পঙ্গু ভাবতে শুরু করেন। খুব তাড়াতাড়ি বাহিনীকে সচল করতে নতুন সৈন্য রিক্রুট করার ঘোষণা দেন। দলে দলে মুসলমান যুবকেরা তার সৈন্যদলে যোগ দিচ্ছিল। এদের বুনিয়াদি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা তিনি তুর্কমানের ময়দানেই শুরু করেন। সৈন্যক্ষয় বিপুল হওয়ায় তিনি দামেশক ও মিশরে দ্রুত দূত পাঠালেন রসদ সামগ্রী পাঠানোর জন্যে। অপরদিকে সামান্য একটু অগ্রসর হলেই জ্ঞাতি শত্রুদের খতম বা পরাজিত করে তিনি মৌসুল, হিরন, আলেপ্পো নিজের অধীনে নিয়ে ফিলিস্তিনের পথ পরিষ্কার করতে পারতেন কিন্তু তার সেনাদের অবস্থা মোটেও অগ্রসর হওয়ার মতো ছিল না।
এটা আমার বিজয় নয়, এ বিজয় খ্রীস্টানদের। কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বিজয়ের পর বলেছিলেন আইয়ূবী। খ্রীস্টানরা চাচ্ছিল আমরা পরস্পর যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়ি; তাদের সে আশা পূরণ হয়েছে। ওরা আমার ফিলিস্তিন অভিযান বিলম্বিত করতে পেরেছে। এই সুযোগে ওরা ফিলিস্তিনের জবর দখল আরো মজবুত করতে পারবে। হায়! স্বজাতি ভাইয়েরা যদি বুঝতো যে, বেঈমানেরা আমাদের কখনও বন্ধু হতে পারে না, ওরা বন্ধুরূপী দুশমন। ওরা আমাদের ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ ভাবতেই পারে না। জানিনা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করে, কারণ আমরা ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে অপরিমেয় জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট করে যাচ্ছি।
আইয়ূবী ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না, জ্ঞাতি শত্ৰু পরাজিত করে স্বস্তি লাভ করলেও তাকে হত্যা করে মুসলিম শক্তিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার নীলনক্সা একই সময়ে চূড়ান্ত হয়ে গেছে ঈসিয়াত দুর্গে। সেখানে তার তৃতীয় শত্রু গোমতগীন হাশিশীনের দলপতি শেখ সিনানের সাথে বসে চুক্তি করে ফেলেছিল। শেখ সিনান খ্রীস্টানদের দেয়া দুর্গে গড়ে তুলেছিল পেশাদার খুনীদের এক বিশাল শক্তি। তা ছাড়া তার নিজস্ব শক্তিশালী সেনা বাহিনীও ছিল দুর্গের অভ্যন্তরে। বিপুল ধন-সম্পদও মজবুত দুর্গের অভ্যন্তরে এই হাশীশ দলপতি গড়ে তুলেছিল স্বতন্ত্র এক মুসলিম বিদ্বেষী রাজত্ব।
ঈসিয়াত ও তুর্কমানের মধ্যবর্তী যে মরুভূমিতে আইয়ূবীর চার গোয়েন্দা সদস্য পথ হারিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, ওরা দুই তরুণীর দেয়া খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা যখন প্রায় ডুবুডুবু তখন চোখ মেলল দলপতি নাসের। ঘুম থেকে জেগে উঠে বসল সে। তরুণী দুজন তখনও জাগ্রত, বসে বসে ওদেরকেই পর্যবেক্ষণ করছে। তরুণীদের দেখে পুনরায় ভড়কে গেল নাসের। যদিও বড় তরুণীটি তাদের সাথে যে ব্যবহার করেছিল তাতে বিপদের তেমন আশংকা ছিল না কিন্তু ওদেরকে জিন ভেবে পুরোপুরি আশ্বস্থ হতে পারছিল না নাসের। তার মধ্যে পুনরায় জিনের শক্তিমত্তার কল্পিতরূপ ভেসে উঠল।