ভোর বেলায় আল্লাহু আকবারের তাকবীর ধ্বনিতে ঘুম ভাঙল আইয়ূবীর। তিনি তাঁবুর বাইরে এলে তার একান্ত খাদেম জ্বলন্ত মশাল তার সামনে রাখল। এ সময় এক অশ্বারোহী এসে থামল আইয়ূবীর সামনে। ঘোড়া থেকে নেমে বলল, সুলতানের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক। আমাদের ডানবাহুর কাছেই সৈন্যবাহিনীর আগমন বোঝা যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে দুজন খবর এনেছে। শত্রুবাহিনী আসছে।
আইয়ূবী শীর্ষ কমান্ডারদের নাম ধরে বললেন, ওদের জলদি ডাকো। সুলতান মাটিতে বসে তৈয়াম্মুম করলেন। পানি আনিয়ে অযু করার সময় নেই। জায়নামায ছাড়াই ঠায় দাঁড়িয়ে দুরাকাত নামায পড়লেন। নামান্তে খুবই সংক্ষিপ্ত দুআ শেষ করে তার ঘোড়া নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন।
মোজাফফর উদ্দীন ছাড়া এ লস্কর আর কারো নয়। অধিনায়কদের উদ্দেশ্যে বললেন আইয়ূবী। আমি নিশ্চিত খ্রীস্টান বাহিনীর সৈন্য নয় এরা। খ্রীস্টানদের অভিযানের ধরণ এমন নয়। যদি এ সংবাদ সঠিক হয় যে, দুশমন আমাদের ডান বাহুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে তবে খেয়াল রাখবে দৃশ্যতঃ দুশমন ডান বাহুতে আত্মপ্রকাশ করলেও হামলা হবে উভয় বাহুতে। উভয় দিকে দুশমনদের প্রতিরোধ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আমাদের কোন বাহিনী যেন পশ্চাৎপসরণ না করে। পিছনে খননকৃত দেড় হাজার কবর আমাদের সৈন্যদের জন্যে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হবে।
সুলতান আইয়ূবী অশ্বারোহণ করলেন। তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর চৌকস বারোজন তার অনুগামী হল। আট দশজন দ্রুতগামী অশ্বারোহীকেও তিনি সাথে নিলেন পয়গাম বহনের জন্য। আরো সাথে নিলেন দুজন অধিনায়ক। ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তিনি। একটি উঁচু টিলার উপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। যেখান থেকে তার ডান বাহুর সৈন্য ও সামনের গোটা এলাকা দৃশ্যমান হয়। তখন ভোরের আঁধার কেটে যাচ্ছে প্রায়। এমন সময় তিনি ডান বাহুর কমান্ডারদের ডেকে নির্দেশ দিলেন, অশ্বারোহীদেরকে সওয়ার করে দাও এবং পদাতিক ইউনিটের তীরন্দাজদের অগ্রসর হয়ে গুহা, গর্ত ও পাহাড়ের ঢালে মরিচাবন্দী হতে নির্দেশ করো।
এখন থেকে ডানবাহুর চীফ কমান্ড থাকবে আমার হাতে। প্রত্যেক অধিনায়ক ও কমান্ডার সংবাদবাহীদের সাথে রাখো। সব সময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। আমার সর্বশেষ নির্দেশ পালনে তৎপর থাকবে।
আইয়ূবীর সামরিক ট্রেনিং-এ দ্রুত স্থান বদলের কৌশলকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হতো। রণাঙ্গনে তার যে কোন নির্দেশ অভাবনীয় দ্রুততার সাথে পালিত হতো। মোজাফফর উদ্দীনের বাহিনীর দৃষ্টিসীমায় আসার আগেই আইয়ূবী তাঁর বাহিনীকে তৈরী করে ফেললেন।
* * *
অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে আক্রমণ করল মুজাফফর। যখনই মুজাফফরের অশ্বারোহী বাহিনী সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীর মুখোমুখি হলো, অমনি টিলার গর্তে, পাহাড়ের ঢালুতে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজেরা তীর বৃষ্টি শুরু করে দিল। তীরের আঘাতে শত্রুবাহিনীর ঘোড়া লুটিয়ে পড়তে লাগল, আহত ঘোড়াগুলো এদিক সেদিক দৌড়াতে শুরু করল। অনাকাক্ষিত প্রতিরোধের মুখে হতভম্ব হয়ে গেল মোজাফফরের অশ্বারোহীরা। মুজাফফরের কাছে হঠাৎ আক্রমণের মুখে পতিত হওয়া বিস্ময়কর ঘটনা ছিল না। কিন্তু সে ভেবেছিল যে, সুলতানের অজ্ঞাতে ইচ্ছে মতো সুবিধাজনক জায়গায় সুলতানকে লড়াবে সে। সে আশা ব্যর্থ হয়ে গেল। ধারণাতীতভাবে সুলতানের প্রতিরোধের মুখে পড়ে গেল মুজাফফর। সুলতানের বহু তীরন্দাজ এ আক্রমণে হতাহত হলো কিন্তু এই লোকসানের বিনিময়ে তিনি স্বস্তি লাভ করলেন। মুজাফফরের আক্রমণের তীব্রতা কমে এলো। প্রতিপক্ষের অশ্বারোহীরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও জনবল হারাল।
এখন আইয়ূবী স্বাধীনভাবেই তাঁর রণকৌশল বাস্তবায়নের সুযোগ পেলেন। মোজাফফর উদ্দীনের একটি অশ্বারোহী দল বহু সংখ্যক সাথীর লাশ ফেলে এগিয়ে এলো, সামনেই ছিলেন সুলতান নিজে। তিনি আক্রমণকারীদের আগমন দেখে তার বাহিনীকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। আক্রমণকারীরা যখন একেবারেই কাছে চলে এলো, তখন সুলতানের বাম বাহুর অশ্বারোহী বাহিনী নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে আরো বামে চলে গেল। অনুরূপ ডানের অশ্বারোহীরাও আরো ডানে সরে পড়ল। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি না হয়ে খালি ময়দানে এগিয়ে গেল অধিকাংশ শত্রু সৈন্য। কিছু সৈনিক ডানে বামে মোড় নিয়ে সুলতানের বাহিনীর মুখোমুখি হল। এবার সুলতানের বাহিনী উভয় দিক থেকে শত্রুসেনাদের দুই বাহুতে আক্রমণ করল। তাদের কোন আঘাত আর ব্যর্থ হলো না। প্রতিটি আঘাতেই শত্রুসেনা পড়তে লাগল। শত্রুবাহিনীর মূল অংশটি সোজা সামনে এগিয়ে যাওয়ায় তাদের দুই বাহুর সাহায্যে এগিয়ে আসার সুযোগ রইল না। ওদের জন্যে এখন একটাই পথ সামনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। সামনের ফাঁকা জায়গাটুকুতেই ছিল সদ্যখননকৃত দেড় হাজার কবর। ওরা সেই কবরের উপর দিয়েই যেতে লাগল।
মুজাফফর ভড়কে যাওয়ার পাত্র নয়। সে কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী পাঠিয়ে অবস্থা বুঝে নিতে চাচ্ছিল। যখন দেখল অগ্রগামী দল সুবিধা করতে পারেনি, সাথে সাথে পঙ্গপালের মতো দ্বিতীয় দলকে পাঠালো। ওরা এমন গতিতে এসে সুলতানের বাহিনীর পিছনে আক্রমণ করল যখন সুলতানের বাহিনী শত্রুবাহিনীকে কবরে তাড়া করে নিজেরা কবর থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েছে মাত্র। পিছন থেকে এসে তাদের উপর হামলে পড়ল মুজাফফরের দ্বিতীয় অশ্বারোহী ইউনিট। সুলতানের অশ্বারোহীরা ঘোড়া ঘুরিয়ে ওদের মোকাবেলার অবকাশই পেলো না। প্রতিপক্ষের তাড়া খেয়ে কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী কবরে নিপতিত হতে লাগল। ওদিকে বাম বাহুতেও একই সাথে আক্রমণ করে বসল মুজাফফর বাহিনী।