তাকে গ্রেফতার করে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে নিহত হয়েছিল অন্য আরেকজন। দেখা গেল নিহত লোকটিও ক্যাম্পের কোন সৈনিক নয় বৃদ্ধেরই সাথী। রাতের আঁধারে শত্রুসেনা মনে করে অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই ওকে হত্যা করেছিল এই ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। ওদের উটের মালপত্র তল্লাশী করে দেখা গেল, কোন মালপত্র নেই, সবই ধোকাবাজী।
তাকে ধরে নিয়ে গেল একজন সহ-অধিনায়কের তাঁবুতে। সহ-অধিনায়ক জেগে উঠল। সহ-অধিনায়ক তাকে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করল কিন্তু তার মুখ থেকে কোন তথ্যই উদ্ধার করতে পারল না, সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করল ধৃত ব্যক্তি। তার মুখোেশ দেখানো হলো অধিনায়ককে। মুখোশের ব্যাপারে পূর্ববৎ নীরব রইল সে। তাকে বলা হলো যে, তোমার এই মুখোশকে তুমি কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। তোমাকে অবশ্যই স্বীকার কতে হবে যে তুমি আইয়ূবীর সৈনিক, তোমার সহযোগীও আইয়ূবীর গোয়েন্দা। কোন কথাই বলল না অভিযুক্ত। তাকে বহু শাস্তি দেয়া হলো। নির্যাতন করা হলো কিন্তু আইয়ূবীর সাথে সংশ্লিষ্টতার স্বীকৃতি স্বীকার করল না। রাত পেরিয়ে গেল।
সকালে মোজাফফর উদ্দীনের সামনে হাজির করা হল তাকে। বলা হল রাতের সব ঘটনা। তার নকল দাড়ি, মুখোশ ও উটের কৃত্রিম মালপত্রও রাখা হল মোজাফফর উদ্দীনের সামনে।
আলী বিন সুফিয়ানের শিষ্য তুমি, না হাসান বিন আব্দুল্লাহ্র? জিজ্ঞেস করল মোজাফফর।
আলী বিন সুফিয়ান আইয়ূবীর মিলিটারী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আর হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ তার ডিপুটি। অভিযুক্ত ব্যক্তি বলল, আমি এদের কাউকেই চিনি না।
বলল মুজাফফর–তুমি না চিনলেও আমি চিনি তাদের। উস্তাদ সাগরিদকে কখনও ধোকা দিতে পারে না। বুঝলে?
আপনার বা আইয়ূবীর সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই, আপনাদের সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহও নেই আমার।
হতভাগ্য বন্ধু! শোন, অভিযুক্তের কাঁধে হাত রেখে বলল মুজাফফর। তোমার সাথে তর্কে যাবো না আমি। আমি একথাও বলবো না, তুমি অযোগ্য। তুমি নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছো। ধরা পড়ে যাওয়া সৈনিকের জীবনে কোন দূষণীয় ঘটনা নয়। তোমার দুর্ভাগ্য যে তোমার সাথী তোমার হাতেই নিহত হয়েছে। তুমি শুধু আমাকে একথা বলো যে, তোমার কোন সাথী এখানকার পরিস্থিতি অবলোকন করে আইয়ূবীর কাছে পৌঁছে গেছে কি? আর একথা বল, এ মুহূর্তে কোন কোন জায়গায় তোমাদের সৈন্য অবস্থান করছে এবং কোন দল কোথায় আছে? এসব কথার জবাব দিলে আমি কুরআনের শপথ করে বলছি-যুদ্ধ খতম হতেই তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে সম্মানের সাথেই এখানে রাখা হবে।
আপনার কসমের উপর আমার আস্থা নেই। কেননা কুরআনের বিশ্বাস থেকে আপনি বিচ্যুত। বলল অভিযুক্ত।
আমি কি মুসলমান নই? ক্ষোভ হজম করে ধৈর্যের সাথে বলল মোজাফফর। আপনি মুসলমান বটে কিন্তু আপনি কুরআন তো খ্রীস্টানদের সহযোগী।
তুমি আমাকে যে অপবাদই দাও না কেন সবই আমি সহ্য করব, যদি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও তুমি। তোমার মনে রাখা উচিত; তোমার জীবন এখন আমার হাতের মুঠোয়।
আল্লাহর কাছ থেকে আপনি আমার জীবন ছিনিয়ে নিতে পারবেন না। আপনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আপনি জানেন আমাদের প্রতিটি সৈনিক জীবন আল্লাহকে সোপর্দ করেছে। আপনাকে বলে দিচ্ছি–আমি সুলতানের একজন গোয়েন্দা, আমার সাথীও গোয়েন্দা দলের সদস্য। আমি এর বেশী কিছু বলতে পারব না। জীবন্ত অবস্থায় আমার দেহ থেকে চামড়া তুলে নিলেও আমার মুখ থেকে আর কিছু শুনতে পারবেন না আপনি। একথাও আমি আপনাকে বলে দিতে পারি যে, আপনার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
পায়ে রশি বেঁধে ওকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দাও। একটি বৃক্ষের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে তাঁবুতে চলে গেল মোজাফফর উদ্দীন।
* * *
ওরা দুজনতো এখনো ফিরে এলো না। আইয়ূবীর সাথে বলছিল হাসান বিন আলী। ওদের তো গ্রেফতার হওয়ার আশংকা নেই। আমাদের গোয়েন্দা গ্রেফতার করতে পারে এ অঞ্চলে! এমন কে আছে, তাছাড়া বেশী দূর যাওয়ারও কথা নয় এদের।
হয়তো ওরা গ্রেফতার হয়েছে। সকালে যাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত ফিরে না আসার অর্থ হলো ওরা ধরা পড়েছে। ওদের গ্রেফতার করার লোক রয়েছে এ অঞ্চলেই। আজ রাতে আরো দূর দিয়ে পর্যবেক্ষণ টিম পাঠাও। বললেন সুলতান।
সুলতানও গোয়েন্দা বাহিনীর ডিপুটি ধৃত দুই গোয়েন্দা সম্পর্কেই কথা বলছিলেন। সুলতান আইয়ূবীর প্রধান হাতিয়ার ছিল গোয়েন্দা ব্যবস্থা। তিনি গোয়েন্দাদের অগ্রিম তথ্যের ভিত্তিতেই রণকৌশল নির্ধারণ করতেন। ফলও হতো আশাপ্রদ। কিন্তু মোজাফফর উদ্দীনের কার্যক্রম সম্পর্কে অগ্রীম তথ্য সংগ্রহে আইয়ূবীর গোয়েন্দা সূত্র ব্যর্থ হচ্ছিল। গত পরশু রাতে তুকমানের বিরানভূমিতে সুলতানের এক গোয়েন্দাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পাঁজরে তীর বিদ্ধ। ছিল। মোজাফফর উদ্দীন ছিল সুলতানের বাহিনীর একজন শীর্ষ কমান্ডার। সে তার অধীনস্থদের বলেছিল, আইয়ূবীর গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে যদি বেকার করে দিতে পার তবেই তোমরা আইয়ূবীর বিরুদ্ধে বিজয়ের আশা করতে পার। গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া আইয়ূবী অচল। সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবে। আইয়ূবী দুই গোয়েন্দার ফিরে না আসা এবং একজনকে মৃত পাওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। অন্যেরা এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলেও আইয়ূবী হাসান বিন আলীকে বললেন–তুমি জোর তৎপরতা চালাও। আরো লোক পাঠাও। নিশ্চয়ই আমাদের ধারে পাশে শত্রু অবস্থান নিয়েছে। আইয়ূবীর নির্দেশে হাসান বিন আব্দুল্লাহ্ ছয়জনের একটি বিশেষ দলকে তথ্য সগ্রহে পাঠিয়ে দিলেন।