আইয়ূবীর ডান বাহুতে কি পরিমাণ সৈন্য রয়েছে এবং এরা কতটুকু শক্তিশালী মনে হয় তোমার কাছে?
অন্তত এক হাজার অশ্বারোহী আর দেড় হাজার পদাতিক সৈন্য হবে। বলল, গোয়েন্দা কমান্ডার। এরা সম্পূর্ণ আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত। এদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করা সম্ভব নয়।
মোজাফফর উদ্দীনের সামনে খোলা নকশার এক জায়গায় সে হাত রেখে বলল, এখানে অবস্থান করছে শত্রু বাহিনীর ডান বাহু। আমার ধারণা, এরা অন্তত আটশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের সামনের জায়গাটা খুব উঁচু নীচু। ওদের ডানপাশটা পরিষ্কার। আক্রমণের জন্য ডানপাশটাই বেশী উপযুক্ত মনে হয় কিন্তু আক্রমণ সামনের দিক থেকেই করা উচিৎ, তাহলে এরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
আমার আক্রমণ সামনের দিক থেকেও হবে, ডান দিক থেকেও হবে। ওদের খোঁড়া কবরগুলোকে ব্যবহার করব আমি। ডেপুটিকে বলল মোজাফফর। অপরিচিত কোন ব্যক্তিকে কোথাও পেলে ধরে নিয়ে আসবে, এখানকার গোটা এলাকাই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কোন সাধারণ লোক এ মুহূর্তে এদিকে আসবে না। গোয়েন্দা ছাড়া এদিকে আর কাউকে দেখতে পাবে না তুমি। কাজেই অজ্ঞাত লোক পেলেই তাকে গ্রেফতার করতে হবে।
* * *
অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে দুই অভিযাত্রীর হয়তো জানা ছিল না, এই এলাকাটি যুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। একজন অভিযাত্রী উটে আরোহণ করেছিল। সে ছিল বয়স্ক। দীর্ঘ ধবধবে সাদা দাড়ি। কান্তিময় চেহারা। তার উটে বোঝাই করা কিছু মালপত্র। অপর লোকটি উটের মিহার টেনে আসছিল। উভয়েই ছিল গ্রামীণ পোশাকে সজ্জিত। মোজাফফর উদ্দীনের নিয়ন্ত্রিত এলাকা অতিক্রম করছিল তারা। মোজাফফর উদ্দীনের গোয়েন্দারা জায়গায় জায়গায় ওঁৎ পেতে ছিল সুলতানের গোয়েন্দা শিকারের জন্যে। অভিযাত্রীর নজরে পড়ে গেল মোজাফফর উদ্দীনের সেনাবাহিনী। অমনি এক সৈন্য ওদের থামাতে হাঁক দিল। সেনার হাঁক শুনে ওরা চলার গতি বাড়িয়ে দিল। এক অশ্বারোহী গিয়ে অভিযাত্রীদ্বয়ের পথ আগলে দাঁড়ালে থামল তারা। সৈনিক তাদেরকে বলল, আমার সাথে চল।
আমরা মুসাফির। তোমাদের আমরা কি ক্ষতি করলাম যে আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছ? আমাদের পথ ছেড়ে দাও।
এ পথে যে কাউকে পাওয়া যাবে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। অতএব তোমাদের যেতে দেয়া হবে না। অশ্বারোহী সৈনিক অভিযাত্রীদ্বয়কে তার সাথে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করল।
তাদেরকে একটি তাঁবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল এক কমান্ডার। কমান্ডার উভয়কে নানা কথা জিজ্ঞেস করল। তাদের জবাবে সন্দেহমুক্ত হয়ে গেল কমান্ডার। কিন্তু তাদেরকে জানানো হলো, তোমাদের যেতে দেয়া হবে না। তোমাদের বন্দী নয় মেহমান হিসেবে কদিন এখানেই রাখা হবে। তারা বারবার প্রশ্ন করলেও পরিষ্কারভাবে একথা বলা হয়নি কদিন তাদেরকে এখানে আটকে রাখা হবে। এরাই ছিল প্রথম অভিযাত্রী; যাদেরকে মোজাফফর উদ্দীনের সৈন্যরা তাদের এলাকা থেকে ধরে নজরবন্দী করে রেখেছিল। তাদের আর কোন কথাই শোনা হলো না। দুজন সৈনিকের হাতে ওদের তুলে দিয়ে বলা হলো, ওদেরকে তোমাদের তাঁবুতে রাখবে।
যে দুই সৈনিকের তাঁবুতে অভিযাত্রীদ্বয়কে রাখা হয়েছে ওরা ঘুমিয়ে। উভয়েই নাক ডাকছে। কিন্তু বৃদ্ধের চোখে ঘুম নেই। সে যখন নিশ্চিত হলো, সৈনিক দুজন ঘুমিয়ে অচেতন তখন সাথীকে খোঁচা দিয়ে জাগাল সে। উভয়েই হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর দরজা পর্যন্ত পৌঁছল। দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নিল বাইরের পরিস্থিতি। বাইরে কাউকে না দেখতে পেয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ল দুজন। তাঁবু থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বৃদ্ধ সাথীকে বলল, তুমি আমার কাছ থেকে ভিন্ন হয়ে যাও। যেদিক থেকে পারো ক্যাম্পের সীমানা পেরিয়ে যাও।
ওরা ভেবেছিল ক্যাম্পে হয়তো সবাই ঘুমিয়ে। আসলে কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করে রেখেছিল মোজাফফর উদ্দীন। ছায়ার মতো কিছু একটা নড়তে দেখে ডাক না দিয়ে অনুসরণ করল এক প্রহরী। ছায়াটি ছিল সেই বৃদ্ধ। সে প্রহরীকে দেখে লুকিয়ে পড়ল। প্রহরী এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করল জিনিসপত্রের স্কুপের মধ্যে। কিন্তু বিশাল পণ্যের ফাঁকে বৃদ্ধ লোকটি এভাবে নিজেকে আড়াল করল যে প্রহরী তাকে খুঁজে বের করতে পারল না। প্রহরী চলে যাওয়ার পর বৃদ্ধ লোকটি অন্ধকারে পা টিপে টিপে জায়গা ছেড়ে আরো সরে আসল। একইভাবে অপর এক প্রহরী বৃদ্ধের সাথীকেও দেখে ফেলল। মোজাফফর উদ্দীনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল নিচ্ছিদ্র। সে জানতো আইয়ূবীর গোয়েন্দারা খুবই পারদর্শী। এরা মাটির নীচ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এজন্য সে সেনা ক্যাম্পে রাত্রিকালীন প্রহরার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যাতে আইয়ূবীর কাছে তার কোন তথ্য পাচার না হতে পারে বা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী তার ক্যাম্পের ক্ষতি করতে সুযোগ না পায়। নির্দেশ মতো প্রহরীরা ছিল পূর্ণ সতর্ক। অপর এক প্রহরীর দৃষ্টি পড়ল বৃদ্ধের সাথীর উপর। কিন্তু সে সন্দেহভাজনকে না ডেকে ওর পিছু নিল। বৃদ্ধের সাথীও প্রহরীর দৃষ্টি এড়াতে লুকিয়ে পড়ল। এদিকে অনুসরণকারী প্রহরীর সাথে কানামাছি খেলায় মেতেছিল বৃদ্ধ। এমতাবস্থায় বৃদ্ধ কিছুক্ষণ পর এমন এক জায়গায় লুকিয়ে পড়ল যে, প্রহরী তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ তার কোমরের খঞ্জর বের করে ফেলল, প্রহরীর খবরদারী থেকে নিষ্কৃতির জন্য সে প্রহরীকে হত্যা করবে। খঞ্জর হাতে নিয়ে প্রহরীর অবস্থান পরখ করছিল বৃদ্ধ আর ভাবছিল কোন দিক দিয়ে সে ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারবে। ঠিক এই মুহূর্তে তার একেবারে পিছনে এসে দাঁড়াল এক লোক। বৃদ্ধ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই সেই লোকের বুকে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল। পরপর দুবার বিদ্ধ করল বুকে ধারাল খঞ্জর। আর্তচিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটি। বৃদ্ধ সেখান থেকে পালানোর দিক ঠিক করছিল, এমন সময় পিছন থেকে একজন তাকে ঝাঁপটে ধরল। বৃদ্ধ এমন তীব্র ঝটকা দিল যে, ঝাঁপটে ধরা লোকটি দূরে ছিটকে পড়ল। ভোঁ দৌড় দিল বৃদ্ধ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বৃদ্ধের পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে জিনিসটির সাথে সে হোঁচট খেয়েছিল উঠে তাকে ঝাঁপটে ধরল। নিরাপত্তা রক্ষীদেরই কজন গাছের মতো শুয়ে পড়েছিল মাটিতে সম্ভাব্য শত্রুকে ঘায়েল করতে। তাদেরই একজন বৃদ্ধকে ধরতে দৌড় লাগাল পিছে পিছে। দৌড়ে সে ধরে ফেলল বৃদ্ধকে। চিৎকার দিল তার সহযোগিতার জন্য। শত শত মশাল জ্বলে উঠল বিপদ সংকেত পেয়ে। প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি করেও বৃদ্ধ মুক্ত হতে পারল না বহু জনের পাকড়াও থেকে। সবাই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল, দৃশ্যত বৃদ্ধের গায়ে এতো তাকত যে, প্রশিক্ষিত অনেকজনের সাথেও সে যে শক্তির মহড়া করেছে, তা হতবাক করল তাদের। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে বৃদ্ধের সাদা দাড়ি খসে বেড়িয়ে এল কালো দাড়ি। মুখোশের আড়াল খসে বেরিয়ে এলো তাগড়া জোয়ান চেহারা। সবাইতো হতবাক। একি! এযে সেই বৃদ্ধ। কিন্তু ওকে আমরা যেমন দেখেছিলাম সেতো সে রকম নয়! খুব কৌশলে কালো দাড়ির উপরে সাদা দাড়ি প্রতিস্থাপন করে বৃদ্ধ সেজেছিল লোকটি। এবার বুঝতে কারো বাকি রইল না; এ যে পাকা গোয়েন্দার কৌশলী কাজ।