* * *
নাসেরের মিশন যেমন সফল হয়েছিল তার সেনাবাহিনীর মিশনও ছিল সফল। তার জানার কোন উপায় ছিল না, সুলতান আইয়ূবী কৌশলের ফাঁদে ফেলে তিন বাহিনীর কমান্ডার সাইফুদ্দীনকে কতটুকু বিপর্যয়ে ফেলেছিলেন। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সাইফুদ্দীন সৈন্যসামন্ত ফেলে রেখেই রণাঙ্গন থেকে পালিয়েছিল। সাইফুদ্দীন পালিয়ে যাওয়ার পর আইয়ূবী সাইফুদ্দীনের চীফ কমান্ডার মোজাফফর উদ্দীনের পাল্টা আক্রমণের অপেক্ষায় ছিলেন। আইয়ূবী আশংকা করছিলেন মোজাফফর উদ্দীন যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তবে জবাবী হামলা করা ছাড়া ফিরে যাবে না।
আইয়ূবীর আশংকা ভিত্তিহীন ছিল না। মোজাফফর উদ্দীন ঠিকই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তিনবাহিনীর এক চতুর্থাংশের কমান্ড ছিল তার অধীনে। বাকীরা আইয়ূবী বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। কিন্তু মোজাফফর উদ্দীন পালালো না; কারণ তার অধীনস্থ এক চতুর্থাংশ সৈন্য ছিল রিজার্ভ। ওরা যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার আগেই সাইফুদ্দীনের কমান্ড ভেঙে যায়। তার বাহিনী শোচনীয় মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়।
আইয়ূবী তার অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার আলোকে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, মোজাফফর উদ্দীন অবশ্যই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে এবং সুযোগ মতো সে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাবে! ঐ ছিল আইয়ূবীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি। সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তি পাঁচটি হলেও বিশেষ ব্যক্তিদের এমন ধরনের নিরীক্ষণ ক্ষমতা থাকে যে, এর দ্বারা তারা সাধারণের চেয়ে ভিন্ন কিছু আন্দাজ করতে পারেন। আইয়ূবীর এ ধারণাও ছিল তদ্রূপ।
তিনি গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিলেন বহু দূর পর্যন্ত। সবাইকে নির্দেশ দিলেন কারো চোখে সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব অনুভূত হলেই আমাকে দ্রুত সংবাদ পৌঁছাবে। আইয়ূবীর সৈন্যরা ভেবেছিল, যৌথবাহিনীর কমান্ডার সাইফুদ্দীন পালিয়ে গেছে এবং যুদ্ধ পুরোপুরিই খতম। তাদের মতে শত্রুবাহিনীর আর কোন জীবিত সৈন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না রণাঙ্গনে। হয় সবাই পালিয়ে গেছে, অন্যথায় আহত-নিহত হয়েছে।
এলাকাটি ছিল আইয়ূবীর গোয়েন্দাদের জন্যে দুর্গম। ঘন টিলা, ঝোঁপঝাড়, পর্বত সংকুল। যে কোন টিলার আড়ালে ঘন ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে গোটা একটা বাহিনী আড়াল করে রাখা কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না। আইয়ূবীর যে গোয়েন্দারা মুক্ত এলাকায় শত্রুবাহিনীর পেটের খবর বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিল, তারা এই দুর্গম অঞ্চলের সব টিলা আর পর্বতের আড়াল খুঁজে দেখার অবকাশ পেল না।
মোজাফফর উদ্দীন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আড়াই মাইল দূরে একটি বড় পর্বতের আড়ালে গুহার মতো জায়গায় নিজের বাহিনীকে আড়াল করে রেখেছিল। সে তার তাঁবুতে বসে আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। খুব তাড়াতাড়িই চাচ্ছিল সে আইয়ূবীর উপর আঘাত হানতে। এমন সময় তার তাঁবুতে প্রবেশ করল তার আর এক ডেপুটি। ডেপুটির সাথে অন্য এক লোক।
নতুন কোন সংবাদ আছে? জিজ্ঞেস করল মোজাফফর উদ্দীন।
সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর সেনাবাহিনী বহাল তবিয়তে রয়েছে। বলল ডেপুটি। ও স্বচক্ষে দেখে এসেছে সবকিছু, ওর মুখ থেকেই শুনুন।
ডেপুটির সাথের লোকটি ছিল মোজাফফর উদ্দীনের গোয়েন্দা। সে বলল, আইয়ূবীর সৈন্যরা আমাদের পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের রসদপত্রও কুড়ায়নি। শুধু আহতদের উঠিয়ে নিয়েছে। আর ওদের ও আমাদের মৃতদেরকে আলাদাভাবে দাফন করছে।
মৃতদের খবরের কোন দরকার নেই আমার। জীবিতরা কি করছে, ওদের সংবাদ বল। বলল, মোজাফফর উদ্দীন। যারা মরে গেছে তাদেরকে দাফন তো করতেই হবে, আর সেটি তারা করবে, এটা তোমার সংগ্রহের মতো কোন সংবাদ নয়। সেটি বল, আইয়ূবী কি তার সেনাদের অবস্থানে কোন হেরফের করেছে? তার সৈন্যদের ডান বাহু কি আগের অবস্থানেই রয়েছে?
সম্মানিত সেনাপতি! আমি সিপাহী নই, কমান্ডার। যে সংবাদটি পরিবেশন করছি তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝে-শুনে, চিন্তা-ভাবনা করে করছি। আমি আপনাকে খুশী করার জন্যে, আপনার ক্ষোভের ভয় করে কিছু বলছি না। আপনি যেমন আইয়ূবীর জয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করতে চান, আমারও প্রত্যাশা তা-ই। আপনার প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আক্রমণ-আয়োজন দ্রুত করুন তাতে অসুবিধা নেই কিন্তু তাড়াহুড়ো করবেন না। মেহেরবানী করে আমাকে বলতে দিন। আমি বলতে চাই–আপনার দৃষ্টি আইয়ূবীর ডান বাহুর দিকে। কেননা, আপনার জন্যে আইয়ূবীর ডান বাহুতে আক্রমণ শানানো সহজ হবে কিন্তু আমি তার বাম বাহুকেও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, তার ডান বাহু আক্রান্ত হলে বাম বাহুতে অবস্থানরত সৈন্যদের সে খুব তাড়াতাড়ি টেনে এনে আঘাত প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।
তুমি বলতে চাচ্ছো, সে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে তাইনা? বলল মোজাফফর উদ্দীন। তার চাল আমি জানি। আমি এক অবস্থায় স্থির থাকব না। কখনও আমাদের সৈন্যদেরকে ছড়িয়ে দেবো, আবার কখনও সংকুচিত করবো। ওদেরকে খেলিয়ে খেলিয়ে নাস্তানাবুদ করবো আমি। তুমি যা বলবে এসব অগ্রিম আমি বলে দিতে পারি।
আইয়ূবী তার যে রিজার্ভ সৈন্য ব্যবহার করে আমাদের বাহিনীকে পরাজিত করেছে, ওদেরকে সে আবার পিছনের সারিতে সরিয়ে নিয়ে প্রস্তুত রেখেছে। আপনার ধারণা ঠিক, সে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে। আমি কবরের যে কথা বলছিলাম, তা হলো, আইয়ূবীর ডান বাহু যেখানে অবস্থান নিয়েছে, ওখান থেকে এক ক্রোশ দূরে। প্রায় দেড় হাজারের মতো হবে কবরের সংখ্যা। আপনি জানেন, দেড় হাজার কবর খননে কতটুকু জায়গায় গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আপনি এভাবে হামলা করবেন, যাতে আইয়ূবীর সৈন্যরা পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়, যাতে তারা খননকৃত কবরের কাছে চলে যায়। আপনি কি ভাবতে পারেন, ওরা যখন সওয়ারী ঘোড়াগুলো নিয়ে গর্তগুলোতে পড়তে থাকবে মৃতদেহ দাফনকৃত কবরগুলোর খোঁড়া মাটিতে ঘোড়ার পা তলিয়ে যাবে তখন অবস্থা কি দাঁড়াবে?