আমরা যদি জিন না হতাম, তাহলে তোমরা আমাদের সাথে কি ব্যবহার করতে? বলল তরুণী।
আমরা মানুষরূপী পাথর। নারী সৌন্দর্য আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে না। তোমরা মানুষ হলে যদি জানতে পারতাম যে, রাস্তা ভুলে গেছো, তাহলে আমাদের ঈমানের মতোই পবিত্র আমানত মনে করে তোমাদেরকে আমাদের দায়িত্বে নিয়ে নিতাম। বাস্তবে তো তোমরা মানুষ নও। তোমাদের মতো হুর এমন জাহান্নামে আসতে পারে না। তোমরা অবশ্যই জিন। আমার অনুরোধ, তোমরা আমাদের নিরাপত্তা দান কর!
আমরা মনুষ্য জাতির অন্তর্ভুক্ত নই। বলল বড় তরুণী। আমরা জানতাম তোমরা কি করতে পার। আমরা এটা জানতাম যে, তোমরা পথ হারিয়ে ফেলেছ। তোমরা যে মরুতে পথ হারিয়েছিলে সেখান থেকে কোন মানুষ বেঁচে আসতে পারে না। কোন গোনাহগার এই মরুভূমিতে পথ হারালে সে আর পথ খুঁজে পায় না। মরু তাদের রক্ত শুষে নেয়। তপ্ত বালুকারাশি হাড় গোশত খেয়ে ফেলে। কিন্তু তোমরা পরহেজগার। আমরা তোমাদের সাথেই ছিলাম কিন্তু তোমাদের এজন্য কষ্ট দেয়া হয়েছে যাতে কষ্টযন্ত্রণা সহ্য করে তোমাদের কু-রিপু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। মন বদ খেয়াল মুক্ত হয়। আমাদের আশংকা ছিল, আমাদের মতো সুন্দরী রমণী দেখে তোমরা বেশামাল হয়ে পড়বে।
তোমরা আমাদের সাথে সাথে রইলে কেন? জিজ্ঞেস করল নাসের।
তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন–যিনি পথভোলা মরুযাত্রীদের পথ দেখান। বলল বড় তরুণী।
তোমাদের উপর আল্লাহ্ যে দয়া করেছেন তা হিসাব করে তোমরা শেষ করতে পারবে না। তিনি আমাদের বলেছিলেন, পুরুষ মানুষ মৃত্যুমুখেও নারীলোভ সামলাতে পারে না। তোমাদের অন্তর থেকে কুপ্রবৃত্তি দূর করার জন্যই তিনি তোমাদেরকে ক্ষুধা পিপাসার দুর্ভোগে ফেলেছিলেন। অতঃপর তোমরা যখন একেবারে কষ্টের শেষ ঠিকানা স্পর্শ করেছ, তখন আমাদের নির্দেশ করেছেন, এদেরকে তোমরা আশ্রয়ে নিয়ে নাও। আমরা জানতাম, শত্রুদের কিভাবে তোমরা নাকানী চোবানী খাইয়েছো।
তাহলে আমার কাছ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলে কেন? প্রশ্ন করল নাসের।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কতটুকু সত্য আর কী পরিমাণ মিথ্যা বল তা বোঝার জন্য। তোমরা সত্যবাদী।
মিথ্যা আমরা কখনও বলি না। বলল নাসের। জানো, রাতের ঝটিকা বাহিনী আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কাজ করে। আমরা যখন কাজ করি তখন আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে কোন অধিনায়ক থাকে না। আল্লাহকে হাজির নাজির মনে করে আমরা অপারেশন করি। আমরা মনের মধ্যে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে নিই যে, আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং সর্বদ্রষ্টা। তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন। তাকে ফাঁকি দেয়ার কোন সুযোগ নেই।… থেমে গেল নাসের। আচ্ছা তুমি কিন্তু আমার সেই প্রশ্নের জবাব দাওনি, আমাদের সাথে তোমরা কি ব্যবহার করবে?
আমাদের যা হুকুম করা হয়েছে, এর বরখেলাপ আমরা করতে পারি না। বলল তরুণী। আমাদের আচরণ খারাপ হবে না। আমরা দেখছি, তোমাদের মুখে কথা ফুটছে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু তদুপরি ভয়ের কারণে তোমরা ঘুমাতে পারছ না। আমি তোমাদের অভয় দিচ্ছি, কোন ভয় নেই, সাথীদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
তারপর কি হবে? জিজ্ঞেস করল নাসের।
আল্লাহ্র যা নির্দেশ তাই হবে। তবে পালানোর ইচ্ছা করলে এই বালির ঢিবির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। এই যে দেখছো বালির টিলাগুলো! এগুলো আসলে টিলা নয় মানুষ। অপরাধ করার কারণে এগুলোকে এভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আমাদের হুকুম নেই এগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করার। না হয় তুমি তরবারী দিয়ে আঘাত করলে এগুলো থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হতে দেখতে পেতে।
একথা শুনে নাসের ও সাথীদের চোখ ভয়ে গোল হয়ে গেল। সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।
এই মরু–যমীনের জাহান্নাম। পাপিষ্ঠ লোক ছাড়া এখানে কেউ পথ হারায় না। যারা এখানকার পথভোলা মুসাফিরদের পথ দেখায়, এরা হয় হরিণের বেশ ধরে আসে, নয়তো আমাদের মতো সুন্দরী নারীর বেশ ধরে আসে। তাদের পানি পান করায়, খাবার দেয় এবং পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু জানো, মানুষ স্বভাবতই অপরাধ প্রবণ। যে হরিণ এদেরকে পথ দেখানোর জন্যে হরিণের বেশ ধরে আসে, ওরা সেটিকেই বিষাক্ত শরাঘাতে হত্যা করে খেতে চায়। আর আমাদের মতো সুন্দরী নারী দেখলে ওদের অসহায় মনে করে সম্ভ্রম লুটে নেয়, হারেমের বউ করার প্রস্তাব করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, এসব কর্মই তাদের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনবে। ওই যে সব টিলা দেখছো, সবগুলোই তোমাদের মতো পুরুষ ছিল, কিন্তু তোমাদেরকে এমন বানানো হবে না।
তোমরা শুয়ে পড়। আমাদের দেখে যদি তোমাদের মধ্যেও কোন বদখেয়াল মাথাচাড়া দিয়ে থাকে তবে সেই বদখেয়ালটিকেও ঘুম পাড়িয়ে দাও। নইলে কিন্তু তোমাদের পরিণতিও হবে ওদের মতো। যা তোমরা নিজ চোখে দেখছো। আসলে এটা মানুষের একটা চরম দুর্বলতা যে, মানুষ যে সুখের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে সেই সুখানুভূতির জন্যে মানুষ ধ্বংস টেনে আনে, করুণ পরিণতি বরণ করে। মানুষের এই আত্মদুর্বলতা বহু জাতিকে ধ্বংস করেছে।
তরুণীর কথা ছিল যাদুমাখা। ওদের কথা থেকে নাসের ও সাথীরা কল্পনাও করতে পারেনি এরা এই মর্তের নারী। ওদের প্রতিটি কথার মধ্যে অলৌকিকতার আলোকচ্ছটা। তরুণীর কথায় নাসের ও সাথীরা স্বপ্নলোকের ঐশী প্রেরণায় আপুত। ভুলে গেল তারা নিজেদের অস্তিত্বের কথা। ধীরে ধীরে প্রত্যেকের চোখ বুজে এলো ঘুমে। এক এক করে সবাই ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল। সবাই যখন ঘুমে অচেতন, তখন বড় তরুণীটি ছোট তরুণীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস।