তোমাদের পরিচয় কি, কোত্থেকে এসেছো? জিজ্ঞেস করল তরুণী।
আগে পানি পান করাও! অনুরোধ করল নাসের। শুনেছি, জ্বিনরা না-কি বলার সাথে সাথে সবকিছু হাজির করতে পারে।
ঘোড়ার পিঠে পানির পাত্র আছে। ওখান থেকে একটি খুলে নিয়ে এসো।
নাসের একটি ঘোড়ার জিন থেকে পানির পাত্র খুলে নিল। এরপর সবার আগে বেহুশ সাথীর চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিল। পানির ঝাঁপটায় সে চোখ খুলে উঠে বসল। নাসের পানির পাত্রটি এগিয়ে দিল ওর মুখে। সে পান করল কয়েক ঢোক। এরপর অন্যদেরকেও অল্প অল্প করে পান করাল। নিজেও পান করল কয়েক ঢোক। পানি পানের পর নাসেরের ঘোর কেটে গেল। সে অনুভব করল এরা জিন্নাত হতে পারে না। জিন হলে আমাদের চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসার সাথে সাথে ওরা উধাও হয়ে যেতো। কিন্তু ওরাতো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আরো অনুভব করল পানিতো তারা কল্পনায় পান করেনি। বাস্তবিকই পান করেছে। শরীরটায় প্রাণ ফিরে এসেছে। এতো জীবন্ত বাস্তবতা। আবারো গভীরভাবে নিরীক্ষা করল তরুণীদের। আগের চেয়ে বেশী সুন্দর লাগছে ওদের। আবারো সৌন্দর্যের মোহে আত্মহারা হলো নাসের। না, এরা মানুষ হতেই পারে না। মানুষ কি এতো সুন্দর হতে পারে? এরা অবশ্যই জিন হবে।
ক্ষুধা-পিপাসা, আবেগ-যাতনায় নাসেরের দেমাগ এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, সে বিষয়টিকে আর বাস্তবতার নিরীখে যাচাই করার শক্তি পেল না। সে অনুভব করল, তার বিবেক বোধ আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। মৃতপ্রায় সাথীদের মধ্যে প্রাণ ফিরে এসেছে। কিন্তু মেয়ে দুটিকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যে দেখা দিল আতংক। তারা যে জায়গাটিতে বসা ওখানে ছায়া ছিল, তাই মরুর আগুন অতোটা তাদের গায়ে পড়ছিল না কিন্তু বাইরের দিকে তাকানোর শক্তি ছিল না কারো। আগুনে লু হাওয়া মাঝে মধ্যেই ওদের জানিয়ে দিল কতো ভয়ংকর যাত্রা তারা পাড়ি দিয়ে এসেছে।
তরুণী দুটি নীরবে দেখছিল ওদের। আর নাসের ও সাথীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। ভিতরে ভিতরে ওদের আতংক। তাদের জানা মতে, জিনরা অনেক শক্তির অধিকারী। ইচ্ছে হলে, পাহাড় উঠিয়ে চাপা দিতে পারে, আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। এমনকি মানুষকে অপহরণও করে ওরা। জানা নেই এরা ওদের সাথে কি ব্যবহার করে।
বড় তরুণীটি ডান হাতের মধ্যমা উঁচু করে হাত প্রসারিত করল নাসেরের দিকে। বলল, ওই পুটলীটা খুলে তোমার সাথীদের দাও।
যন্ত্রচালিতের মতো নাসের ঘোড়ার জিন থেকে পুটলী খুলে আনল। খুলে দেখল ওর মধ্যে কিছু খেজুর ছাড়াও রয়েছে রান্না করা শুকনো গোশত। সাধারণত আমীর ব্যক্তিরা এ ধরনের গোশত খেয়ে থাকে। পুটলী খুলে নাসের তাকাল তরুণীর দিকে।
তরুণী বলল, সাথীদের নিয়ে খাও!
নাসের সাথীদের মধ্যে সবগুলো ভাগ করে দিল। বাহ্যত খাবারের পরিমাণ বেশী ছিল না। স্বাভাবিক অবস্থায় এগুলো একজনের খাবার। কিন্তু সবাই মিলে খেয়েও তারা তৃপ্ত হলো। কারণ কয়েক দিনের টানা অনাহার, অনিদ্রা ও তৃষ্ণায় ওদের পেট-পিঠের সাথে লেগে গেছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। চিবিয়ে খাবার মতো শক্তি পর্যন্ত রহিত হয়ে গেছে। পানি পানের পর তাদের মধ্যে যে প্রাণ ফিরে এসেছে এর ফলে খাবারগুলো চিবুতে পেরেছে তারা। সবাই খাবার গলাধঃকরণ করে যখন পানি পান করল, তখন তাদের কাছে জগতটা মনে হলো অন্য রকম। তরুণীদ্বয় হয়ে উঠেছে আরো সুন্দরী, জান্নাতী হুর যেন।
এখন তোমরা আমাদের সাথে কি আচরণ করবে? বড় তরুণীটিকে প্রশ্ন করল নাসের। কারণ জিন আর মানুষের মধ্যে কোন সমতা নেই। তোমরা আগুনের তৈরী, আমরা মাটির মানুষ। অবশ্য আমরা সবাই আল্লাহর মাখলুক। দয়া করে তোমরা আমাদেরকে তুকমানের পথটি দেখিয়ে দাও। ইচ্ছে করলে মুহূর্তের মধ্যে তোমরা আমাদের পৌঁছে দিতে পার তুর্কমানে।
তোমরা কি কোথাও রাতের বেলায় গুপ্ত হামলা করতে গিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করল বড় তরুণী। সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনীও জিনের মতো। বল তোমরা কোথা থেকে কি করে এসেছো?
তরুণীর জিজ্ঞাসায় নাসের তার গোটা কার্যক্রম বলে দিল। তার ইউনিট কতো ভয়ংকরভাবে শত্রু বাহিনীর রসদপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে সবিস্তারে বলল সবই। কিভাবে তারা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে তাও বলে দিল নাসের।
মনে হয় তোমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে তোমরা সেরা, বলল তরুণী। তোমরা যে কাজ কর, তোমাদের প্রত্যেক সৈনিকই কি এ ধরনের অপারেশন করতে পারে?
না। যে কোন সৈনিক আমাদের মতো ঝটিকা অপারেশন করতে সক্ষম নয়। আমাদের তুমি সাধারণ মানুষ মনে করো না। আমাদের উস্তাদ আমাদেরকে যে কঠিন প্রশিক্ষণ দিয়েছে সাধারণ সৈনিক তা সহ্য করতে পারবে না। চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র আমাদের গতি, হরিণের মতো মরুভূমিতেও আমরা দৌড়াতে পারি। ঈগলের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আমরা। শারীরিক গঠনের দিক থেকেও আমরা অন্য সাধারণের চেয়ে ভিন্ন। বিরূপ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠিক রেখে সঠিক কাজটি আমরা করতে পারি।
আমরা এ ব্যাপারেও প্রশিক্ষণ নিয়েছি, শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে কিভাবে ওদের গোপন তথ্য বের করে আনা যায়। আমরা যে কোন সময় বেশ পাল্টাতে পারি, আওয়াজ বদল করতে পারি। একাধিক ভাষা জানি। প্রয়োজনে অন্ধের ভূমিকা পালন করতে পারি। ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা হলে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করি। গ্রেফতার হওয়া আমাদের জীবনে নেই, আমরা লড়াই করে শাহাদাত বরণ করি কিন্তু কখনও গ্রেফতার বরণ করি না।