* * *
অতি কষ্টে সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের নীচুভূমি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল নাসের। যেন জীবন্ত এক কাফেলা। দুটি সমতল অনুচ্চ টিলার বুক অতিক্রম করছিল তারা। নাসের আগে আগে সাথীরা তার পিছনে। একটু সামনে নাসের দেখতে পেল অনেক পূর্বেকার পানিবাহিত একটি মরা নদীর ছাপ। হয়তো শতবছর আগে এখানে পানি ছিল, পানি প্রবাহের চিহ্ন রুক্ষ মরু এখনও ধরে রেখেছে।
হঠাৎ নাসের মাথা ঝাঁকাল, চোখ দুটি রগলে নিল একটু। নিজের দৃষ্টির উপরে বিশ্বাস করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে পুনরায় চোখ মেলল, কিন্তু পূর্ববৎ সেই দৃশ্যই দেখতে পেল নাসের। সমতল টিলাটি এক জায়গায় গিয়ে কিছুটা নীচে গিয়ে হারিয়ে গেছে, কিন্তু এক পাশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি তাঁবুর মতো বাড়তি টিলার আড়ে অল্প জায়গায় ছায়া পড়েছে, সেই ছায়ার মধ্যে দুটি ঘোড়া দাঁড়ানো। ঘোড়া দুটির পাশেই বসা দুটি অনিন্দ্য সুন্দরী, এরা নাসেরের কাফেলাকে আসতে দেখে চকিত হরিণীর মতো সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে উঠে দাঁড়াল।
নাসের এদের দেখে থেমে গেল। সাথীদের জিজ্ঞেস করল, তোমরাও কি ওখানে দুটি ঘোড়া এবং দুজন তরুণী দেখতে পাচ্ছ?
যে দুই সাথী সর্বাগ্রে দৃষ্টিভ্রম ও বোধ বিলুপ্তির শিকার হয়েছিল এদের একজন কোন কথা বলল না। অপরজন বলল, সব ধূয়াশা, আমি কিছুই দেখছি না। যে সাথীর তখনও পর্যন্ত মাথা ঠিক ছিল সে নাসেরের কানে কানে বলল, হ্যাঁ। আমিও তো তাই দেখতে পাচ্ছি।
আল্লাহ আমাদের রহম করুন। আমাদের দেমাগও খারাপ হয়ে গেছে। আমিও মনে হয় তাই দেখছি যা বাস্তব নয়। এই বিরান দোযখে এমন অনিন্দ্য সুন্দরী কোত্থেকে আসবে?
এরা যদি মরু এলাকার যাযাবর হতো তাহলে হয়তো মনে করা যেতো যে আমরা সত্যিই দেখছি। কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তো এমনটি মনে হয় না। আচ্ছা, চলো ছায়ায় বসি। এরা আসলে কোন নারী নয় আমাদের দৃষ্টিভ্রম। বলল নাসেরের সাথী।
আমার কিন্তু বোধশক্তি সম্পূর্ণ ঠিক আছে। বলল নাসের। আমি তোমাদের ঠিক মতোই দেখছি, অনুধাবন করছি তোমাদের কষ্ট। তোমাদের কথাবার্তাও বুঝতে পারছি, আমার কোন বিভ্রম নেই।
দেমাগ আমারও খারাপ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি ভুল না দেখে থাকি তবে মেয়ে দুটি মানুষ নয় জ্বীন হবে। বলল নাসেরের সাথী।
মেয়ে দুটিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে মূর্তির মতো। নাসের সাহসী যোদ্ধা। কোনকিছুর পরোয়া না করে সে মেয়ে দুটির দিকে অগ্রসর হল। কিন্তু মেয়ে দুটি আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য! জ্বীন তো মানুষের উপস্থিতিতে মানুষের অবয়বে থাকে না!
মেয়ে দুটি থেকে নাসের যখন মাত্র পাঁচ/ছয় কদম দূরে তখন এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্কাটি ডান হাত নাসেরের দিকে প্রসারিত করে দিল, তবে তার হাত ছিল মুষ্ঠিবদ্ধ। সে শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুল দুটি নাসেরের প্রতি বাড়িয়ে দিল। থেমে গেল নাসের। এমন অনিন্দ্য সুন্দরী নারী জীবনে কখনও দেখেনি নাসের। মেয়েটির ওড়নার ফাঁকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলো যেন রেশমের সূতীক্ষ্ণ নরম সূতো। চোখ দুটো তারার মতো উজ্জ্বল। গভীর মনোহর চাহনী, এক কথায় কোন মৃতপ্রায় পুরুষের মধ্যেও পৌরুষ জাগানিয়া অপরূপা তরুণী দুটি।
তোমরা সৈনিক! তাই না? জিজ্ঞেস করল বড় মেয়েটি। কার সৈনিক তোমরা?
সবই বলব, কিন্তু এর আগে আমাকে বল, তোমরা কি মরু বিভ্রম না জান্নাতের হুর?
আমার যাই হই না কেন, আগে তুমি বল, তোমরা কে? কোত্থেকে এদিকে কেন এসেছো? আমরা মরু বিভ্রম নই, তোমরা যেমন আমাদের দেখছো, আমরাও ঠিক তোমাদের দেখছি। বলল বড় মেয়েটি।
আমরা সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গেরিলা ইউনিটের সৈনিক। তোমরা যদি জান্নাতের হুর হয়ে থাকো, অথবা জ্বীন গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে থাকো, তবে হযরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোহাই, আমার সাথীদের পানি পান করিয়ে দাও। প্রয়োজনে এর পরিবর্তে আমার জীবন নিয়ে নাও। কারণ এদের প্রাণ রক্ষা করা এখন আমার জিম্মাদারী।
হাতের অস্ত্র আমাদের সামনে ফেলে দাও। হাত নামাতে নামাতে বলল তরুণী। হযরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের আবেদন আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। তোমার সাথীদের ছায়ায় নিয়ে এসো।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরনের শিহরণ অনুভব করল নাসের। যেন শীতল একটা বাতাস মাথা দিয়ে প্রবেশ করে তার পায়ের পাতা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। তার সারা শরীরকে কেমন যেন বোধহীন করে শীতল করে দিয়েছে, যে অনুভূতি একান্তই অনুভবের, ব্যক্ত করার মতো নয়। কারণ মানুষ শত্রুদের মোকাবেলা করতে অভ্যস্ত সে। তার গেরিলা আক্রমণের ভয়ে প্রতিপক্ষ ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। গোটা মুসলিম বাহিনীতে তার ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্য। কিন্তু এই তরুণী দুটির সামনে তার বীরত্ব সাহস সবই কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। তার মনের গহীনে এমন এক ভয়ের সঞ্চার হলো যা কোনদিন সে অনুভব করেনি। জীবনে জ্বীন-পরীর বহু গল্প শুনেছে সে; কিন্তু জ্বীনের মুখোমুখী হয়নি কখনও। তার বিশ্বাস ছিল, যে কোন সময় এই মেয়ে ও ঘোড়া দুটি অদৃশ্য হয়ে যাবে, অথবা রূপ বদলে ফেলবে। এদের বিরুদ্ধে তার কিছুই করার নেই। তাই মেয়ে দুটির সামনে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আসহায় করে ফেলল। সে সাথীদের এসে বলল, চলো ছায়ায় যাই। তার সাথীদের একজন তো ইতিমধ্যেই বেহুশ হয়ে পড়েছিল। তাকে টেনে হেঁচড়ে ছায়ায় নিয়ে গিয়েছিল নাসের।