নাসেরের সাথী নিজ থেকে আবার দৌড় লাগাল। কিন্তু অবসন্ন শরীর তাকে এগুতে দিল না বেশীদূর। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটি পা হেঁচড়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছিল, সেই এখন পর পর দুবার পড়ে গিয়ে আবার সামনের দিকে দৌড়াতে লাগল। এটা ছিল নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের জ্বলে উঠার মতো। নাসের এবার দৌড়ে তাকে ধরে ফেলল। তার অন্য সাথীরাও পরিস্থিতির আকস্মিকতায় দৌড়ে ঐ সাথীকে ধরতে চেষ্টা করল। বেসামাল সাথী নাসেরের পাঞ্জা থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে হাত পা ছুঁড়তে লাগল এবং চেঁচিয়ে বলতে লাগল, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, ঐ যে দেখো পানি ভর্তি পুকুর! সেখানে কত সুন্দর সুন্দর হরিণ দল পানি পান করছে। চলো সবাই সেই পুকুরে গিয়ে পানি পান করি।
সাথীরা তাকে দুবাহুতে ধরে রাখল। বেহুশ সাথী পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে সামনে এগুতে শুরু করল। নাসের তার মাথার কাপড় টেনে চেহারা ঢেকে দিল যাতে সে কিছু দেখতে না পারে।
* * *
মাথার ঠিক উপরে দুপুরের সূর্য তখন আগুন ঝরাচ্ছে। শুষ্ক মরুময় মাটি ফেটে তামার মতো আগুনে রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে আরেক সাথী হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, …ঐ দেখো, কতো সুন্দর বাগান, নর্তকীরা নাচছে। ধিক তোমাদের, পানি…! চলো, নৃত্য দেখি, সুন্দর বাগান দেখি। বন্ধুরা, চলো, ঐ দেখো, সেখানে কতলোক আহার করছে, পানি আছে, অঢেল পানি। আমি ওদের সবাইকে চিনি। কোন অসুবিধা হবে না। চলো!…….। এই বলে সেই সাথীও সামনের দিকে দৌড়াতে লাগল।
যে সাথী কিছুক্ষণ আগে কল্পনায় বেসামাল হয়ে পড়েছিল অনেকক্ষণ ধরে আর কোন কথা বলল না। নিশ্চুপ পথ চলছে। ফলে তাকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিল অন্য সাথীরা। কিন্তু অপর সাথীকে চিৎকার করে দৌড়াতে দেখে ওর পিছনে সেও পুনর্বার দৌড় দিল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল, আহ্! ভারী সুন্দর নৃত্য, এই নর্তকীকে আমি চিনি। কায়রোতে আমি ওকে দেখেছিলাম। ও আমাকে চিনে। আমি ওর সাথে নাচবো, গাইবো। শরবত পান করবো….।
নাসেরের মাথা এবার চক্কর মারল। বোধশক্তি তার তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল। দীর্ঘ যাতনা ও কষ্ট তাকে এখন পর্যন্ত বেহাল করতে পারেনি। কিন্তু সাথীদের বেহাল অবস্থা তাকে অসহায় করে তুলল। এদের এই দুরবস্থায় সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব। তার নিজের শারীরিক অবস্থাও তো ওদের মতোই…। কিন্তু দুজন সাথীকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করা তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব। মাত্র এক সাথীর বোধশক্তি এখনও ঠিক রয়েছে। কিন্তু শারীরিক দিক থেকে তার অবস্থাও যে শোচনীয়!
যে দুই সাথী কাল্পনিক নৃত্যরত নর্তকী ও বাগানের পিছনে দৌড়াল একটু অগ্রসর হয়ে উভয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নাসের ও তার অপর সাথী এদের উঠিয়ে বসাল এবং কাপড় দিয়ে ওদের চেহারা আড়াল করে দিল। এদের মাথা দুলছে, ঘাড় সোজা করতে পারছে না।
বন্ধুরা! তোমরা আল্লাহ্র পথের সৈনিক। তোমরা প্রথম কেবলা ও খানায়ে কাবার রক্ষী। ইসলামের শত্রুদের কোমর ভেঙে দিয়েছো তোমরা। তোমাদের ভয়ে কম্পমান বেঈমান কাফের শক্তি। আগুন পেরিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার মতো মর্দে মুমিন তোমরা। এই রুক্ষমরু, এই সূর্যতাপ, এই ক্ষুৎপিপাসায় তোমরা এতোটা বেসামাল হয়ে গেলে! তোমরা কি লক্ষ্য করেছো, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। মুমেন পানির শীতলতায় নয় ঈমানের উষ্ণতায় বেঁচে থাকে। ক্ষীণ আওয়াজে সাথীদের উদ্দেশে বলল নাসের।
উভয় সাথী চোখ খুলে নাসেরকে দেখল। নাসের তাদের প্রতি তাকিয়ে শুষ্ক হাসি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল। আবেগের আতিশয্যে নাসের সাথীদের উদ্দেশে বলা কথায় কাজ হলো, উভয় সাথী কল্পনার স্বর্গরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলো এবং উঠে খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগল।
সকাল বেলায় যেসব মিনার তাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছিল এগুলো এখন কাছে চলে এলো এবং মিনার ও শহরের অট্টালিকার পরিবর্তে উঁচু উঁচু টিলা ও পর্বত হয়ে চোখের ভ্রম দৃষ্টিকে বাস্তবতার নির্মম অবয়বে ভেসে উঠতে লাগল। অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল এখানকার কোথাও না কোথাও পানি পাওয়া যাবে। নাসের সাথীদের বলল, আশা করি আমরা পানির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হয়তো সন্ধ্যার আগেই আমরা পানি পেয়ে যাবো। কিন্তু পাহাড়ী সেই যমীন ও জায়গাটার বাস্তব অবস্থা দেখে পানি প্রাপ্তির আশা ভোরের শিশিরের মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। যেন পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছল তারা। হঠাৎ করে আবার এক সাথী চেঁচিয়ে দৌড়াতে লাগল এই বলে যে, হায়! আমার গ্রামে এসে গেছি, এই তো দেখা যায় বাচ্চারা কূয়া থেকে পানি উঠাচ্ছে। এসো, এসো। তোমাদের জন্যে আমি উমদা খানাপিনার ব্যবস্থা করব।
আকাশের দিকে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে কাতর মিনতি করল নাসের। বলতে লাগল, আয় যুলজালাল! তোমার নামে আমরা যুদ্ধ করতে এবং মরতে এসেছিলাম। আমরাতো চুরি, ডাকাতি করিনি; তোমার নাফরমানিও করিনি। বেঈমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যদি অপরাধ হয় তবে আমাদের তুমি মাফ করে দাও। আমাদের ক্ষমা করে দাও। হে অসহায়দের সাহায্যকারী প্রভু! আমার জীবন নিয়ে নাও, আমার শরীরের অবশিষ্ট রক্তকে পানিতে পরিণত করে হলেও সাথীদের তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করে দাও, তাদের বাঁচিয়ে রাখো। ওরা তো তোমার রাসূলের সম্মানে বেঈমানদের অধিকৃত প্রথম কিবলাকে উদ্ধার করতে জিহাদ করছে, ওরা কোন কসুর করেনি। আমার রক্ত পানি করে ওদের প্রাণ বাঁচাতে পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা কর প্রভু…! তার সাথীরা উঠে দাঁড়াল এবং দুহাত প্রসারিত করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল যেন তারা কিছু একটা পেয়ে গেছে। নাসের ও তার যে সাথীর এখনও পর্যন্ত মাথা ঠিক ছিল সাথীদের অগ্রসর হতে দেখে সেও পা হেঁচড়ে অগ্রসর হতে লাগল। নাসেরের দুচোখও হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল কিন্তু পরক্ষণেই মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো অন্ধকার কেটে গেল নাসেরের দৃষ্টি থেকে। সে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হলো। নাসের অনুধাবন করল নির্মম মরু সাথীদের মতো তাকেও ধোকা দিতে শুরু করেছে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সবুজ শ্যামলের সমারোহ। অবশ্য বেশী সময় স্থায়ী হলো না দৃষ্টিভ্রম। নাসেরের চোখের সামনে উঁচু টিলা আর পাহাড়ের অবস্থান তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বাধ্য করল।