আমাদের পাঠক মহল ও তরুণ প্রজন্ম যদি এই গল্প পাঠে মিত্র নির্বাচনে সতর্ক হন, শাণিত হয় তাদের আত্মউপলব্ধি তবে আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে।
শহীদুল ইসলাম
২০.০৯.০৩ ইং
.
১. সত্যপথের সৈনিক
১১৭৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল। ৫৭০ হিজরী সনের রমযান মাস। নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর সালতানাতের গুরুদায়িত্ব সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, কিন্তু নূরুদ্দীন জঙ্গীর ছেলে মালিক আস্-সালেহ, গোমতগীন ও গাজী সাইফুদ্দীন যৌথভাবে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। খ্রিস্টশক্তি তাদের অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। খ্রিস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির জন্য যৌথ বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া, উট, অগ্নিবোমা ছাড়াও রকমারী যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। খ্রিস্টানরা চাচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে। সেই সুযোগটাই তাদের হাতে এসে গেল, যখন খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের ইন্ধনে তিন ক্ষমতাধর আইয়ূবীর বিরুদ্ধে আঁতাত গড়ে তুলল, খ্রিস্টানরা হিসেব কষে দেখল সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সাথে যুদ্ধে পেরে উঠা যাবে না। এর চেয়ে যদি তার মিত্রদের বিরোধ উস্কে দিয়ে পরস্পর বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়া যায়, তবে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী ও তার মিত্র উভয় গ্রুপ দুর্বল হয়ে যাবে। এই সুযোগে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে প্রথম কিবলা বাইতুল মোকাদ্দাসের উপর খ্রিস্ট নিয়ন্ত্রণ পাকাঁপোক্ত করা সহজ হবে। এরপর কাবাকেও দখলে আনা সম্ভব হবে। ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।
কিন্তু ওরা বুঝেনি, ইসলাম এমন কোন বৃক্ষ নয় যে, শিকড় কেটে দিলে শুকিয়ে মরে যাবে। ইসলাম কতগুলো কিতাব আর কিতাবের স্তূপ নয় যে, জ্বালিয়ে দিলে ছাই ভষ্ম হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। ইসলাম একটি জীবন দর্শন। যে জীবন দর্শন কতগুলো মৌলিক বিশ্বাস ও কার্যক্রমের সমষ্টি। এসব বিশ্বাস মানুষের হৃদয় রাজ্যে বিরাজ করে, আর সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কাজ-কর্মে। মুসলমানের অন্তঃস্থিত বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তার কাজ-কর্ম, জীবন-যাপন। হাজার, লাখ, কোটি মানুষকে হত্যা করেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইসলামের দর্শন, চেতনা ও বিপ্লবী ধারাকে ব্যাহত করা। ইসলামকে ধ্বংস করে দেয়ার একটিই পথ তা হলো, ইসলামের সৈনিকদেরকে জীবনদর্শন থেকে বিচ্যুত করা। মুসলমানকে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতায় অভ্যস্ত করে ফেলা। মদ, নারী আর আনন্দ সূর্তিতে মজিয়ে রাখা। তাহলে মুসলমানদের জীবন দর্শনে ঘুণ ধরবে। ধর্মের বন্ধন ও শরীয়তের বিধি-নিষেধ শিথিল হতে থাকবে। মুসলমান ধীরে ধীরে আদর্শ বিস্মৃত হয়ে ভোগবাদিতায় লিপ্ত হয়ে যাবে।
সম্মুখ সমরের চেয়ে খ্রিস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও কালচারাল যুদ্ধকে গুরুত্ব দিল। গড়ে তুলল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। অসংখ্য রূপসী তরুণীকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে কৌশলী গোয়েন্দা হিসেবে গড়ে তুলল। বিশাল বিস্তৃত নারীর ফাঁদ তৈরী করে খ্রিস্টানরা আরব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মিশরে জালের মতো ছড়িয়ে দিল প্রশিক্ষিত নারী গোয়েন্দা। ধীরে ধীরে মুসলিম ক্ষমতাসীনদের উঁচুস্তরের কর্তা ব্যক্তিরা খ্রিস্টানদের তৈরী নারী ফাঁদে ধরা দিতে শুরু করল।
সম্ভবত মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক এটাই যে, যুগে যুগে শাসক শ্রেণীর কর্তা ব্যক্তিরাই শত্রুদের তৈরী নারীর ফাঁদে ধরা দিয়ে নিজেদের পতনকে তরান্বিত করেছে।
নূরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর শাসনামলে ইহুদী-খ্রিস্টান শক্তির তৈরী এই সর্বনাশা মরণবিষ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ও কর্তা ব্যক্তিদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছিল। এই কূটকৌশল প্রয়োগ করে খ্রিস্টানরা দখল করে নিয়েছিল অধিকাংশ মুসলিম রাজ্য। দৃশ্যত মুসলিম শাসন থাকলেও অন্তরালে খ্রিস্টানরা ওইসব রাজ্যের কর্তাব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদেরকে পুতুলে পরিণত করেছিল। মুসলমান হলেও তাদের মধ্যে ইসলামী ভাবাদর্শের লেশমাত্র ছিল না। মদ, নারী ও আরাম-আয়েশে আকণ্ঠ ডুবে থাকত। ইহুদী খ্রিস্টানদের সাথেই গোপনে গড়ে তুলেছিল বন্ধুত্ব। এদেরকে কোন অবস্থাতেই ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক ও কর্মকর্তা বলার উপায় ছিল না। নূরুদ্দীন জঙ্গী ও আইয়ূবীর জন্যে এসব গাদ্দার ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।
১৯৭৫ সালে সুলতান আইয়ূবীর সাথে এসব অপরিণামদর্শী মুসলিম শাসকদের বিরোধ চরমে পৌঁছে। ইসলামী শাসনের পক্ষে এরা কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিস্টানরা দূরে বসে মুসলমান শাসকদের আত্মঘাতী সংঘাতের তামাশা দেখছিল।
সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী যখন রণাঙ্গনে একের পর এক খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করছিলেন, খ্রিস্টানরা তখন সম্মুখ সমরে পেরে উঠতে না পেরে মুসলমান নেতাদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল এই যে, নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মালিক আস-সালেহ ইসমাঈল আইয়ূবীর বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে বসে।
নূরুদ্দীন তনয় মালিক আস-সালেহ ইসমাঈল, গোমশতগীন ও সাইফুদ্দীনের যৌথ বাহিনী আইয়ূবীর হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করলে তিন কুচক্রীই রণাঙ্গন থেকে জীবন নিয়ে পলায়ন করে। নূরুদ্দীন জঙ্গীর অধীনস্থ গোমশতগীন ছিল হিরন দুর্গের অধিপতি। জঙ্গীর মৃত্যুর পর সে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সৈন্যসামন্ত রেখেও আইয়ূবীর পশ্চাৎ আক্রমণের ভয়ে হিরন যেতে সাহস পায়নি গোমশতগীন। সে গিয়ে আশ্রয় নেয় ইসমাঈলের স্বঘোষিত রাজধানী আলেপ্পোয়। আলেপ্পোকে ইসমাঈল রাজধানী ঘোষণা করেছিল।