* * *
অতি প্রত্যূষে ঘুম থেকে জাগল নাসের। পরিষ্কার আকাশ। তারা দেখে নাসের আন্দাজ করল রাতের আর কতটুকু বাকি। সাথীদেরও জাগাল। সবাইকে নিয়ে সামনে এগুতে শুরু করল কিন্তু সবার অবস্থাই এমন যে কারো মুখ থেকে কোন কথা বেরুল না। তবে তাদের গতি ছিল গত রাতের চেয়ে কিছুটা তীব্র।
এই মরু প্রান্তর খুব বেশী দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়। হয়তো আজ আমরা মরু এলাকা অতিক্রম করতে পারব, আর তা না হলে আশা করি পানি পেয়ে যাবো। বলল নাসের।
যে পানি দিনের আলোতে ছিল মরীচিকা। রাতের অন্ধকারে তা আশার দীপ শিখায় পরিণত হলো। সেই আশার আলোতেই পথ চলতে শুরু করল নাসেরের কাফেলা। ভোর রাতের আঁধার কেটে পূর্বাকাশে যখন সূর্য উঁকি দিল সেই সাথে বিলীন হয়ে গেল তাদের পানি প্রাপ্তির প্রত্যাশা। অবশ্য নতুন এলাকাটি মরু বালিময় ছিল না, এখানকার যমীন শক্ত কিন্তু দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টিতে ফেটে চৌচির। শুধু পাহাড় আর পাহাড়ী টিলা। কোথাও কোন গাছ-গাছালী নেই। মাটি এতো শক্ত যে পায়ের আঘাতে ধূলো বেরিয়ে আসতো। কতো দিন থেকে এ মাটি তৃষ্ণার্থ তার কোন ইয়ত্তা নেই।
আট দশ মাইল দূরে দেখা গেল সারি সারি পাহাড় আর উঁচু টিলার চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল মিনার চূড়া। যমীনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যেন শত বছর থেকে এরা তৃষ্ণার্ত, হয়তো এই সৈনিকদের রক্ত পান করে এরা তৃষ্ণা মেটাবে।
সাথীদের চেহারার দিকে তাকিয়ে নাসের বুঝতে পারল তার নিজের অবস্থা কি হয়েছে। তার এক সাথীর জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। খুব ধীরলয়ে নড়ছে ঠোঁট। সার্বিক অবস্থা এতই ভয়ংকর যে পুনর্বার কারো দিকে তাকানোর সাহস হলো না তার। অবস্থা এমনই বেগতিক মনে হলো যে, দৃশ্যত মিনারগুলো পর্যন্ত এদের নিয়ে যাওয়া অসম্ভব মনে হলো নাসেরের কাছে।
নাসের এই ছোট কাফেলার কমান্ডার। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন নাসের। যদিও তার নিজের অবস্থাও সাথীদের থেকে ভিন্ন নয়। তবুও জীবনের শেষ শক্তি ব্যয় করে সাথীদের উদ্দেশে দুকথা বলার চেষ্টা করল নাসের। কিন্তু সংকল্প সংকল্পতেই রয়ে গেল, চেষ্টা করেও নাসেরের মুখ থেকে আওয়াজ বের হলো না। তখনও বোধশক্তি অন্যদের তুলনায় স্বাভাবিক ছিল তার। বলার শক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিল।
সূর্য যতই উপরে উঠতে শুরু করল, মরুর আগুন বাড়তে লাগল। সাথীদের অবস্থা এ পর্যায়ে উপনীত হলো যে, তারা পা আর উঠাতে পারছিল না। পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগুচ্ছিল। যে সিপাহীর জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিল তার হাত থেকে বর্শা পড়ে গেল। কোমর থেকে তরবারী খুলে ফেলে দিল সে। সে কি করছিল সেই বোধ ছিল না তার। শরীরকে ভারমুক্ত করতে বোধহীন ভাবেই কাজ করছিল তার দুহাত। সামনে হঠাৎ দ্রুত হাঁটতে লাগল সেই সাথী। মরুর নির্মম যাতনার প্রভাব এমনই যে, পথহারা কোন মুসাফির যখন পথ হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের মতো নিজের অজান্তেই সে ভারমুক্ত হতে শরীর থেকে সব কাপড়-চোপড়, পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাব পত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
মরু মুসাফিররা যখন পথের কোন স্থানে এ ধরনের আসবাব পড়ে থাকতে দেখে তখন তারা ভাবতে থাকে সামনে হয়তো কোন হতভাগার মৃতদেহ দেখতে হবে।
নির্মম মরু নাসেরের এক সাথীকে জীবনের সেই পরিণতিতে পৌঁছে দিল, যে পর্যায়ে পৌঁছালে মানুষ দুনিয়ার আসবাব ও রসদপত্রকে অপ্রয়োজনীয় এবং স্বীয় কর্তব্য ভুলে যায়। নাসের সেই সহযোদ্ধার তরবারী ও বর্শা উঠিয়ে বড় কষ্টে বলল, এতো জলদি হার মেনো না বন্ধু! আল্লাহর পথের সৈনিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে কিন্তু তরবারী ফেলে না। নিজের মর্যাদা ও সম্মানকে বালিতে নিক্ষেপ করো না।
নাসেরের কথায় সাথী তার দিকে তাকিয়ে রইল। নাসেরও অপলকনেত্রে দেখতে লাগল সাথীকে। হঠাৎ সেই সাথী অট্টহাসি শুরু করল এবং গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে বলতে লাগল দেখো–পানি… পানি… বাগান…। এই বলে সামনের দিকে দৌড় মারল। কয়েক কদম এগিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেই সাথী।
বাস্তবে না সেখানে পানি ছিল, না ছিল মরীচিকা। কারণ সেখানকার যমীনের চরিত্র এমন ছিল যে মরীচিকাও প্রতিফলিত হতো না। কারণ ধু ধু বালির উপরে রোদের কিরণ প্রতিবিম্বিত হয়ে পানিময় যে মরীচিকা দেখা যায় সেই যমীনটি সে ধরনের ছিল না। আসলে নাসেরের সেই সাথীর বোধশক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিল তৃষ্ণার যাতনায়। কষ্টে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে প্রত্যাশার কল্পনাই দৃষ্টিভ্রমে পরিণত হয়েছিল বাস্তব কোহেলিকা। কল্পনায় সে পৌঁছে গিয়েছিল সুসজ্জিত ঝর্ণাপাশের মনোরম বাগিচা সদৃশ স্থানে, যেখানে পিপাসার যাতনা নেই, পানির দুর্ভোগ নেই। ধূসর মরুর বুকেরই দৃশ্যমান পাহাড় চূড়াগুলো তার কাছে মনে হচ্ছিল সুসজ্জিত অট্টালিকা, বাতাসের ঢেউ আর ইতস্তত বালিয়াড়ীগুলো তার কাছে মনে হচ্ছিল গমনাগমনরত মুসাফির কাফেলা। মরুর মৃদু বাতাসের উড়ন্ত ধূলোবালিকে মনে হতে লাগল নৃত্যরত গায়িকা।
নির্মম মরু নাসেরের এক সাথীকে পৌঁছে দিয়েছিল বাস্তব রূঢ়তা থেকে কল্পনার আয়েশী জগতে। মরু তার জীবনের আখেরী মুহূর্ত নিয়ে পরিহাসে মেতে উঠল। হয়তো বা এটা নিরস, রুক্ষ মরুর একটা মায়াবী দিক যে, কঠিন যাতনায় কোন মুসাফিরের জীবন হরণের আগে তাকে কল্পনার স্বর্গে প্রতারণার মায়াবীচক্রে নিক্ষেপ করে; যাতে করে যন্ত্রণা থেকে রেহাই পায় হতভাগা মুসাফির।