সূর্য যেদিকে উঠেছে সেদিকে তাকিয়ে দেখল, সারিসারি পাহাড়। ওদিকে তার পক্ষে পা বাড়ানো নিরাপদ নয়। কারণ ওদিকে রয়েছে শত্রু বাহিনী। সাথীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল নাসের। ওরা চোখ মেলেই নিরাশার অন্ধকার দেখতে পেল। নিকট কোন স্থানে পানির দেখা মিলবে এ আশা ক্ষীণ হয়ে উঠল সবার কাছে।
বন্ধুগণ! আরো দুদিন ক্ষুধ-পিপাসা সহ্য করতে পারব আমরা। এই দুই দিনে আমরা ঠিকানায় পৌঁছাতে না পারলেও পানির সন্ধান ঠিকই পেয়ে যাবো।
তিন সাথী প্রত্যেকেই নিজের মতো করে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করল। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এরা মরুভূমির এতোটা গভীরে চলে এসেছে যে, এখান থেকে পায়ে হেঁটে সামনের দিকে হেঁটে কুল-কিনারা পাওয়া খুবই মুশকিল। সে সাথে ঘোড়া থাকলে হয়তো কিছুটা সহজ হতো। তাও তো নেই। অবশ্য রাতের দীর্ঘ ঘুমে তাদের শরীর কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে, দেহে এসেছে সামান্য শক্তি।
নাসের বলল, বন্ধুগণ! আল্লাহ্ তাআলা আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখী করেছেন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং আল্লাহর প্রতি কোন অভিযোগ না করা আমাদের কর্তব্য।
এখানে বসে থেকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে মরা অর্থহীন। এর চেয়ে চলো, আল্লাহ্ তাআলা অবশ্যই কোন পথ বের করে দেবেন। বলল এক সাথী।
চলতে শুরু করল তারা। আন্দাজের উপর দিক নির্ণয় করে নিল। একটু ঘোর পথে অগ্রসর হতে হলো তাদের। কেননা, শত্রু বাহিনীর দৃষ্টি সীমা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাও জরুরী। বেলা বাড়তে থাকল আর মরুর বালুকা রাশি তপ্ত হতে শুরু করল। দৃষ্টি সীমা ছোট থেকে ছোট হতে থাকল। মরুর মরীচিকায় মনে হতে থাকল সামনেই অথৈই পানির দরিয়া। যেন পানি থেকে বাষ্প উড়ছে, কিন্তু সবই ছিল মরীচিকা বাস্তব পানি নয়। এরা সবাই মরু চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত, তবুও পিপাসার কাতরতা তাদের হতাশ মনে মরীচিকাকেই পানি ভাবতে প্রতারণা দিচ্ছিল। নাসের অফুরন্ত প্রাণশক্তির বিনিময়ে এসব মরীচিৎকার ধোঁকায় না পড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরগতিতে।
এক পর্যায়ে নাসের সাথীদের বলল, বন্ধুগণ! আমরা ডাকাত নই যে, আল্লাহ্ আমাদের মরুভূমিতে ঘুরে ঘুরে প্রাণত্যাগে শাস্তি দিবেন। আমরা আল্লাহর পথের মুজাহিদ। যদি মরুভূমিতে আমাদের মৃত্যু হয় তবে কিসের চিন্তা? এ মরণ হবে শাহাদত। কোন অপমৃত্যু নয়। সবাই আল্লাহকে স্মরণ কর। আল্লাহ অবশ্যই এ বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন।
যদি এমন কোন মুসাফির পেয়ে যাই যে, তার কাছে পানি রয়েছে, তবে তার পানি ছিনিয়ে নিতে আমি মোটেও দ্বিধা করব না। বলল এক সাথী।
সাথীর কথায় সবাই হেসে উঠল। অবশ্য এই কষ্ট হাসিতে তাদের খরচ করতে হল সঞ্চিত প্রাণশক্তি।
তখন একেবারে মাথার উপর সূর্যের আগুনে বয়লার। আর নীচে তপ্ত বালুতে জ্বলছে পা। শরীরের ঘাম নিঃশেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সূর্যতাপ আর পিপাসায় শরীরের পানির অংশও নিঃশেষ প্রায়। সবাই মিলে মৃত্যুর পূর্বের তাহলিয়া পড়ার মতো ক্ষীণস্বরে আল্লাহ্ আল্লাহ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে লাগল। আর অবশিষ্ট সামর্থ ব্যয় করে করে সামনে এগুতে লাগল। মরুর তপ্ত লু-হাওয়া তাদের পদচিহ্ন মুছে দিচ্ছিল। এই বাতাস বাতাস নয় যেন আগুনের বয়লার উদগিরণ করছে গোশত গলানো বাম্প।
পশ্চিম দিকে হেলে পড়ল সূর্য, তখন নাসেরও সাথীদের চলার গতি একেবারেই ক্ষীণ। একেক জনের একেকটি পা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে, প্রতিটি কদম উঠাতে এবং সামনে ফেলতে হচ্ছে শক্তির সবটুকু প্রয়োগ করে। সবার মুখ শুষ্ক তবু ঠোঁটে আল্লাহর যিকির।
পড়ন্ত বেলায় তাদের শরীরের ছায়া বালিয়াড়িতে একেবেঁকে খেলা করতে শুরু করেছে, তখন এক সাথীর ঠোঁট নড়াও বন্ধ। কিছুক্ষণ পর অপর এক সাথীর ঠোঁটের স্পন্দনও নিঃশেষ। নাসের ও তার তৃতীয় সাথী শুধু ক্ষীণ আওয়াজে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর যিকির অব্যাহত রেখেছে। আর কিছুক্ষণ পর তাদেরও আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল।
নিজেদের আখেরী ওয়াক্ত সমাগত হতে দেখে শরীরের অবশিষ্ট শক্তির সবটুকুই দিয়ে নাসের সাথীদের উদ্দেশ্যে বলল, বন্ধুগণ! আমাদের শরীরের রক্ত ও জলীয় পদার্থ নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে কিন্তু ঈমানের বাষ্প নিঃশেষ হবার নয়। ঈমানী শক্তি আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। নাসের সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখল সবার মুখই শুকিয়ে পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, চেহারায় রক্তের লেশমাত্র নেই।
সূর্য ডুবে গেল। রাত বাড়ার সাথে সাথে মরুর বালু ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। সাথীদের চলৎশক্তি বারবার থমকে গেলেও নাসের তাদের থামতে দিল না। রাতের ঠাণ্ডায় কিছুটা দ্রুত চলা সম্ভব। নাসের গতি বাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার নিজের গতিইতো রহিত হওয়ার উপক্রম। যদি সে এবং তার সাথীরা আরব যোদ্ধা না হতো এবং সেনা বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হয়ে সাধারণ মুসাফির হতো অনেক আগেই মরুভূমিতে চলৎশক্তি হারিয়ে মরুর বুকে শুকিয়ে মরতে হতো তাদের। কিন্তু বিশেষ ট্রেনিং এবং প্রতিকূল পরিবেশে অত্যধিক কষ্ট সহিষ্ণু হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার কারণে আল্লাহর রহমতে এখনও সাথীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে তারা।
নাসের আরো কিছুক্ষণ চলার পর নিজেই দাঁড়িয়ে গেল এবং সাথীদের বলল শুইয়ে পড়তে।