তুর্কমান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নপর শত্রু সেনাদের তাড়া করতে করতে মূল দল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কমান্ডার আন্-নাসের-এর কমান্ডো ইউনিট। তার সহযোদ্ধাদের সবাই অশ্বারোহী, আগুনে তীর ও আধুনিক বর্শা ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জামে সজ্জিত।
আন্-নাসেরের জন্যে সুবিধা এই ছিল যে, তুর্কমান এলাকাটি ঘন বনজঙ্গল আর টিলা ঝোঁপ ঝাড়ের কারণে সহজেই তারা শত্রু বাহিনীর অনতিদূরে লুকিয়ে থাকতে পারতো এবং সুবিধা মতো রাতের আঁধারে শত্রুদের খাদ্য সামগ্রী বোঝাই গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্রবাহী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দুশমনদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হতো।
এভাবে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্বাবন ও রাতের আঁধারে গেরিলা আক্রমণ করে করে মূল শিবির থেকে বহু দূরে অচেনা জায়গায় চলে আসে তারা। দিনের বেলায় একদিন আন্-নাসের তার সেনা ইউনিট নিয়ে একটি টিলার নীচে তাঁবু খাঁটিয়ে আরাম করছিল, এমন সময় সে দেখতে পেল টিলার আড়াল থেকে শত্রু সেনারা তাদের অবস্থান দেখে ফেলেছে। কমান্ডোদের কজন টিলার উপরে তীর সজ্জিত ছিল, তাই শত্রুসেনারা আক্রমণে সাহস করেনি।
সন্ধ্যা নামতেই আন্-নাসের শত্রু বাহিনীর রসদপত্রের অবস্থান ও শিবিরটি পরখ করে দেখে নিল। ঘোড়াগুলোকে আগের স্থানেই বেঁধে রেখে পায়ে হেঁটে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সে রাতের অপারেশন এতো সহজ ছিল না।
প্রতিপক্ষ গুপ্ত হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে পদাতিক ও অশ্বারোহী প্রহরা নিযুক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু সবকিছু প্রত্যক্ষ করে আন্-নাসের সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক সে আজ রাতেই শত্রুবাহিনীর রসদপত্র ধ্বংস করে দেবে। সিদ্ধান্ত মতো সাথীদের তৈরী করে এক সুযোগে ঢুকে পড়ল শত্রুবাহিনীর রসদপত্রের ডিপোতে এবং আগুন ধরিয়ে দিল জ্বালানী ছিটিয়ে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। সাথীদের বলল, তোমরা ছড়িয়ে পড়। জ্বলন্ত আগুনের আলোতে কমান্ডোদেরকে শত্রুবাহিনী তীরের নিশানা বানাতে শুরু করল। অভিযানকারীরা নিজেদের রক্ষায় সফল হতে পারল না। একে একে সবাই শত্রু বাহিনীর তীরের আঘাতে শাহাদাত বরণ করল। বেঁচে রইল আন-নাসের ও তার সাথী তিনজন। বহু কষ্টে তারা চারজন জীবন নিয়ে শত্রু বাহিনীর ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলো।
শক্র বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে আন্-নাসের আসমানের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন তারা গোচরীভূত হলো না। ঝটিকা বাহিনীকে তারা দেখে দিক নির্ণয় করার ট্রেনিংও দেয়া হতো। সেদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। শত্রু বাহিনীর তাবুর আগুন দূর থেকেও দেখতে পেল নাসের। অন্য সাথীরা বেঁচে আছে না শহীদ হয়েছে মোটেও জানার সুযোগ ছিল না নাসেরের। সে মনে মনে তাদের মঙ্গলের জন্যে দুআ করল এবং সঙ্গীদের নিয়ে যেখানে তাদের ঘোড়া বাঁধা ছিল সেদিকে আন্দাজে রওয়ানা হল।
কিছুক্ষণ চলার পর শক্রশিবির জ্বলার অগ্নিশিখাও আর দেখা গেল না। আকাশে জ্বলন্ত আগুনের যে লালিমা দেখা যেতো কিছুক্ষণ পর তাও মিলিয়ে গেল। পথ হারিয়ে ফেলল নাসের। আন্দাজের উপর চলতে শুরু করল।
অনেকক্ষণ চলার পর মাটির ধরনের পরিবর্তন মনে হলো। পাথুরে শক্ত যমীনের পরিবর্তে বালুকাময় নরম যমীনে দেবে যেতে লাগল পা। যেখানে কোন গাছ-গাছালী তো দূরে থাক কোন ঘাস লতাগুল্মও ছিল না।
বালুকাময় মাটি নাসের ও সাথীদের পাকে নিঃশ্চল করে ফেলল। আহার ও পানি ছিল তাদের অশ্বপৃষ্ঠে বাঁধা। ঘোড়া কোথায় আর নাসের ও সাথীরা কোথায় তা বলা মুশকিল।
নাসেরের প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেল, ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। তার সাথীরা বারবার তৃষ্ণার কথা বলতে লাগল। নাসের সেখানেই বিশ্রাম করার মনস্থ করল কিন্তু সাথীরা। তাকে এই বলে অগ্রসর হতে বলল যে, সামনে হয়তো কোথাও পানি পাওয়া যেতে পারে।
অবশ্য এলাকাটি পানি শূন্য ছিল না, কিন্তু নাসের ও তার সাথীরা সেই অঞ্চলের সে দিকে অগ্রসর হতে থাকল যেদিকে ধুধু মরু ছাড়া পানির নাম-গন্ধও নেই। তারা পানির আশায় আরো কিছুক্ষণ পথচলার পর শ্রান্ত হয়ে সবাই বসে পড়ল।
ক্লান্ত-শ্রান্ত নাসের ও সহযোদ্ধারা কখন ঘুমের জগতে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল সেই অনুমান করার সামর্থ তাদের নেই। রাত পেরিয়ে পূর্বাকাশে সূর্য যখন চারদিকের মরুর বালু তপ্ত করতে শুরু করল তখন চোখ খুলে গেল নাসেরের। চারদিকে ধু ধু বালি আর বালি। সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখল নাসের, তারা তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ঠিক ঘুম নয় যেন কয়টা অসার নিথর মরদেহ।
হতাশায় অবশিষ্ট মনোবলও উবে গেল তার। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল সাথীদের দিকে তাকিয়ে। মরুভূমি নাসেরের কাছে মোটেও অপরিচিত নয়, মরুতেই তার জন্ম। শৈশব থেকে বড় হয়েছে মরুর পরশেই। কত দুর্গম মরু পেরিয়েছে জীবনে, কতবার কঠিন যুদ্ধ করেছে মরুর বুকে। এই মরুভূমি তার চিরচেনা। কিন্তু এখানে এমন আদিগন্ত সীমাহীন মরুতে পথ হারিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি নাসের। মরুর অসীমতার চেয়ে ক্ষুৎপিপাসায় কাতরতা আর সাথীদের চলৎশক্তি রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নাসেরকে আরো মারাত্মকভাবে দুর্বল করে ফেলল।
দৃষ্টি সীমায় কোন সবুজের চিহ্ন নেই, নেই কোন তরুলতা। বিগত দিনের কথা মনে হতেই পিপাসায় জ্বলতে শুরু করল কণ্ঠনালী। সাথীদের অবস্থা তো আরো করুণ।