মোজাফফর উদ্দীনকে যুদ্ধ বিদ্যায় ও আক্রমণ প্রতিআক্রমণ শামলানোর পারঙ্গমতায় যথেষ্ট সমীহ করেন আইয়ূবী। আইয়ূবীর বিরুদ্ধে কুরানে হুমাতের যুদ্ধে মোজাফফর উদ্দীন যে চাল চেলেছিল সুলতান উভয় বাহুর কমান্ড নিজ হাতে নিয়ে তাকে শামাল দিতে হয়েছিল। তারপরও বহু মূল্য দিতে হয়েছিল সুলতানের।
এবারো অনেক শত্রুসেনাকে মোজাফফর উদ্দীনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন সুলতান। তারা সবাই মোজাফফর উদ্দীনকে দেখেছে বললেও ঠিক কোন ইউনিটে রয়েছে সে সম্পর্কে কেউ বলতে পারেনি। এ থেকে সুলতানের ধারণা আরো দৃঢ় হয়েছে যে, মোজাফফর উদ্দীন হামলা না করে মোটেও ফিরে যাওয়ার লোক নয়।
সুলতান যখন তার বাহিনীকে প্রতিআক্রমণের জন্যে তৈরী থাকতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে আইয়ূবীর শিবির থেকে দুই/তিন মাইল দূরে মোজাফফর উদ্দীন সহযোদ্ধাদের বলছিল, আমি লড়াই না করে যাবো না।
ঠিক সে সময় সাইফুদ্দীনের এক গোয়েন্দা এসে মোজাফফর উদ্দীনকে সাইফুদ্দীনের বার্তা জানাল, অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, আমাদের অভিযান সম্পর্কে আগাম খবর পেয়েছিল আইয়ূবী। এজন্য আমরা আত্মপ্রতারিত হয়ে হেরেছি। তোমাকেও সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত। কাউকে কিছু না জানিয়ে আমিও অজানা উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছি।
আমরা আপনার সব নির্দেশ মাথা পেতে নেবো। তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়, যখন আমাদের অধিকাংশ সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছে এবং মাত্র এক-চতুর্থাংশ সৈন্য আমাদের বেঁচে আছে, এমতাবস্থায় আমাদের পক্ষে প্রতি আক্রমণ করা ঠিক হবে না। বলল এক কমান্ডার।
যে পরিমাণ যোদ্ধা আমার কাছে রয়েছে, আমার কাছে এ সংখ্যাই যুদ্ধের জন্যে যথার্থ। কেননা আইয়ূবী এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেও বিজয়ী হয়ে থাকে। এবার আমি তাকে ডানবাহু দিয়ে আক্রমণ করবো। বিগত কুরানে হুমাতের চাল এবার তাকে আমি চালতে দেব না। বলল মোজাফফর উদ্দীন। তোমরা মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হও।
আলী মাকাম! মৌসুলের গভর্নর তিনবাহিনীর বিশাল সমর আয়োজন ও শক্তি নিয়েও পরাজিত হয়েছেন। এতো অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আপনার প্রতিআক্রমণ করা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। আমি আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্যে অনুরোধ করছি। বলল ডিপুটি সেনাপতি।
যে অধিনায়ক যুদ্ধ ময়দানে শরাবের মশক আর হেরেমের নর্তকী নিয়ে আসে ওদের নের্তৃত্বে তিন কেন দশটি সেনাবাহিনী থাকলেও সাইফুদ্দীনের মতোই পরিণতি বরণ করতে হবে। বলল মোজাফফর উদ্দীন।
শরাব আমিও পান করি বটে কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে একটু পানিও যদি না মিলে আমার পরোয়া নেই। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আমাকে বেঈমান, গাদ্দার বলে থাকে, কিন্তু মুসলমান বলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত হবো না। কেননা, এযুদ্ধ হবে দুই সেনাপতির, দুই কৌশলী সমর নায়কের মোকাবেলা…..।
তোমরা সবাই নিজ নিজ ইউনিটকে তৈরী রাখো, কেননা, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দারা মাটির নীচের খবরও বলতে পারে। আজ রাতের অভিযানকে আরো সতর্কতার সাথে পরিচালনা করো। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত প্রহরী ছড়িয়ে দাও। কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তি দেখা মাত্রই যেন ধরে নিয়ে আসে। কমান্ডারদের বলল সেনাপতি মোজাফফর উদ্দীন।
শিবির স্থাপনের জন্যে মোজাফফর উদ্দীন এমন একটি জায়গা নির্বাচন করল যেখানে অনায়াসে সৈন্যরা তাবু খাঁটিয়ে থাকতে পারে। দূর থেকে কারো চোখে পড়ার অবকাশ নেই। মোজাফফর উদ্দীন হামলার জন্যে কোন সময় ঠিক করেনি–কমান্ডারদের সে বলল–সুলতান আইয়ূবী শিয়ালের মতো ধূর্ত আর খরগোশের মতো ক্ষীপ্রগতির মানুষ। আমার গোয়েন্দারা খবর দিয়েছে, সে এখনও মালেগনীমত কুড়ায়নি এবং তার দুই প্রান্তের সৈন্যদেরকেও ফিরিয়ে নেয়নি। এর মানে হলো, সে এখনই যুদ্ধ শেষ করতে চাচ্ছে না, সে আশংকা। করছে আমি প্রতিআক্রমণ করব। কিন্তু এবার তাকে আমি অন্য চালে কুপোকাত করবো। সে দুদিনের বেশী প্রতিআক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করবে না। আমি দুদিনের মধ্যে আক্রমণ করবো না। তার সৈন্যরা যখন মালে গনীমত কুঁড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সেই সুযোগে আক্রমণ করবো আমি। কারণ, আমি তার যুদ্ধ কৌশল জানি, বুঝি কোন ক্ষেত্রে সে কি সিদ্ধান্ত নেবে। আমি আক্রমণ বিলম্বিত করে তাকে এ ধারণা দেব যে, আমরা পালিয়ে গেছি, তার আর প্রতিআক্রমণের আশংকা নেই। দেখো, এবারের মোকাবেলা হবে দুই বাহাদুরের বুদ্ধি ও কৌশলের লড়াই। বাস্তবে মোজাফফর উদ্দীনের এ আক্রমণের আশংকাই করছিলেন আইয়ূবী।
* * *
অকল্পনীয়ভাবে সাইফুদ্দীনের বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে সুলতানের সৈন্যরা। সাইফুদ্দীন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এমন ঝড়ের মধ্যে আইয়ূবীর বাহিনী তার বিশাল বাহিনীর উপর চতুর্দিক থেকে হামলে পড়বে।
সুলতান ফৌজীর সংবাদ পেয়ে ঝড়ের তাণ্ডব কমার সাথে সাথেই তীরন্দাজ বাহিনীকে সাইফুদ্দীনের বাহিনীর দুই প্রান্ত থেকে আরো নিরাপদ দূরত্ব ঘুরে পিছনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন, সেই সাথে ঝটিকা বাহিনীর বিশেষ কমান্ডোদেরও পাঠিয়ে দেন শত্রুসেনাদের রসদপত্রের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে।
চারজন করে একটি টিমে মোট তিনটি টিমের সমন্বয়ে বারোজনের একটি ইউনিট বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠন করা হতো। এসব যোদ্ধা শক্তি সাহস ও বাহাদুরীতে থাকতো অনন্য এবং বুদ্ধি ও কৌশলেও হতে প্রতিপক্ষের জন্যে যমদূত। এমনই একটি ইউনিট পলায়নপর শত্রুসৈন্যদের পশ্চাদ্বাবন করতে করতে বহুদূর পর্যন্ত চলে গিয়ে অসামান্য সাফল্য লাভ করে কিন্তু বারোজনের গোটা ইউনিটে মাত্র তিনজন বেঁচে থাকল; আন্-নাসের এই ইউনিটের কমান্ডার।