কিন্তু সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিজয়ী বাহিনী এর ব্যতিক্রম। তাঁর কঠোর নির্দেশ– যতো বড় অফিসারই হোক না কেন শত্রু বাহিনীর কোন মালে গনীমতের দিকে হাত বাড়ালে তাকে ক্ষমা করা হবে না। মালে গনীমত জড়ো করা এবং সেগুলোর পরিমাণ নির্ণয় করার জন্যে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেডকে নির্দেশ দেয়া হতো। শুধু তারাই মালে গনীমত কুঁড়ানোর কাজ করবে। সকল আসবাব ও প্রাপ্ত সম্পদ জড়ো হওয়ার পর সুলতান আইয়ূবী নিজের হাতে মালে গনীমত সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। তুর্কমানের সেই ভয়াবহ যুদ্ধ অবসানের পর আইয়ূবী মালে গনীমত কুঁড়ানোর নির্দেশ কোন ব্রিগেডকে দেননি। তিনি স্বদলীয় ও শত্রুবাহিনীর আহত সৈনিকদের তাঁবুতে তুলে আনা, তাদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা ও মৃতদের দাফন-কাফনের জন্যে সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। হুকুম দিলেন আহত কয়েদী ও সুস্থ কয়েদীদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখতে, যাতে কারো অযাচিত কষ্টের মুখোমুখি হতে না হয়।
রণাঙ্গনে আইয়ূবীর রীতি-নীতি ও কৌশল ছিল খুব কঠোর ও অলঙ্ঘনীয়। চূড়ান্ত লড়াইয়ে যৌথবাহিনী অকল্পনীয় আক্রমণে দিকভ্রান্ত হয়ে পালাতে শুরু করে। সুলতান আইয়ূবীর বিশেষ বাহিনী ওদের পশ্চাদ্বাবন করে। সুলতানের ওইসব পশ্চাদ্বাবনকারী বাহিনী শত্রু সেনাদের তাড়িয়ে নেয়ার সময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং একটা নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হতো। সুলতান পশ্চাদ্বাবনকারীদের ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন এবং ডানে বামের দুই বাহুতে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সেনাদের পূর্বেকার মতো সতর্ক প্রহরা অব্যাহত রাখতে বললেন।
আক্রমণে সুলতান ব্যবহার করেছিলেন ঝটিকা বাহিনী, তীরন্দাজ ইউনিট ও মিনজানিক পরিচালনাকারীদের। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বাহুতে অবস্থানকারী সৈন্যদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ফিরিয়ে আনেননি। হামলা শেষ হওয়ার পর পরই তিনি তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ড পুনরায় নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিলেন। শত্রুদের আসবাব, সওয়ার, গাড়ি ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র কি করা হবে? মাননীয় সুলতান! জানতে চাইল এক সেনাপতি। লড়াইয়ে আমাদের বিজয় হয়েছে।
এখনও আমি বিজয়ের আনন্দে বিভোর হতে পারছি না। যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমার শিক্ষা তোমাদের এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে না। বললেন সুলতান। আমরা শত্রুদের কেন্দ্রীয় কমান্ড তছনছ করে দিয়েছি বটে কিন্তু আমাদের কোন ইউনিট কি তাদের দুবাহুর কোনটিতে আক্রমণ করেছিল? মনে হয় না। তাহলে বুঝতে হবে ওদের দুই বাহু না হোক অন্তত একটি বাহু অক্ষতই রয়ে গেছে। ওদের সেনাপতি ঈমান বিক্রেতা হতে পারে কিন্তু ওদের আনাড়ি ভাবা ঠিক হবে না। তাদের যে সেনা ইউনিট সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে তারা জবাবী আক্রমণ না করে ক্ষান্ত হবে না। এ-ও ত হতে পারে যে, তাদের রিজার্ভ ফোর্সও সম্পূর্ণ বহাল তবিয়তে রয়েছে।
ওদের কেন্দ্রীয় কমান্ড নিঃশেষ হয়ে গেছে সুলতান! তাদের সেনাদের কমান্ড দেয়ার মতো কেউ নেই। বলল এক সেনাপতি।
খ্রীস্টান বাহিনীর প্রতিআক্রমণের আশঙ্কাও করছি আমি। এ অঞ্চল খুবই জটিল। অসংখ্য টিলাপাহাড়ে ভর্তি। হতে পারে খ্রীস্টান বাহিনী কোন টিলার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সুযোগের প্রত্যাশায়। শত্রুবাহিনী আর সাপের উপর কখনও নির্ভর করা ঠিক নয়। মরতে মরতে সাপ যেমন ছোবল মারতে পারে শত্রুবাহিনীও চরম দুরবস্থার মধ্যেও প্রতিআক্রমণ করে বসতে পারে। তাছাড়া সাইফুদ্দীনের কমান্ডার মোজাফফর উদ্দীনের কোন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তোমরা সবাই জানো, মোজাফফর উদ্দীন এতো সহজে পালিয়ে যাওয়ার পাত্র নয়। আমি তার অপেক্ষা করছি। তোমরা সবাই সতর্ক থেকো। সৈন্যদের একত্রিত করো। মোজাফফর। উদ্দীন যদি আমার সবক ভুলে গিয়ে না থাকে তবে দেখবে সে অবশ্যই জবাবী হামলা করবে।
সুলতানের আশংকা ছিল যথার্থ। মোজাফফর উদ্দীন সুলতান আইয়ূবীর সেনাবাহিনীতে উঁচু পদের অফিসার ছিল এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড দীর্ঘদিন খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। এক পর্যায়ে স্বার্থের মোহে পড়ে সাইফুদ্দীনের জালে পা দিয়ে সুলতানের শত্রুবাহিনীতে যোগ দেয়। মোজাফফর উদ্দীন ভালোভাবে জানে আইয়ূবী কোন দিকগুলোর প্রতি বেশী গুরুত্ব দিয়ে রণাঙ্গনের পরিকল্পনা তৈরী করেন এবং যুদ্ধ চলাকানীর সময়ে কতো নাটকীয় ও নিপুণভাবে রদবদল করেন। মোজাফফর উদ্দীন ব্যক্তি হিসেবে যেমন সাহসী তেমনি মেধাবী। দীর্ঘদিন সুলতান আইয়ূবীর সান্নিধ্যে থেকে মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের দ্বারা যোদ্ধা হিসেবে তার বিশেষ একটা অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে গোটা মুসলিম বাহিনীতে। মোজাফফর উদ্দীনের মেধা প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা এবং বীরত্ব তাকে রণাঙ্গন থেকে পালানো থেকে বিরত রাখে। গভর্নর সাইফুদ্দীনের চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে শাসন ক্ষমতা ও মসনদের প্রতিও কিছুটা আসক্তি জন্মে মোজাফফর উদ্দীনের মনে। সুলতান মিশর থেকে বাগদাদ পদার্পণ করলে বাগদাদের অধিকাংশ। ক্ষমতাশীন ব্যক্তি ও শীর্ষ আমলাশ্রেণী সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে ঠিক এ সময়ে মোজাফফর উদ্দীনও সুলতানের পক্ষ ত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে শামিল হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়।