রাতের বেলায় বিশেষভাবে তৈরী একটি তাঁবুতে আপন ভাইয়ের লাশের পাশে বসে ফৌজী বলছিল –আমি রক্ত নদী পার হয়ে তোমার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি দাউদ! ভাইয়ের মৃতদেহ আমার কর্তব্য পালনের সাক্ষী হয়ে আমার চোখের সামনেই পড়ে রয়েছে। দাউদ! আমি সেই রক্ত ফোরাত পেরিয়ে এসেছি যেখানে কোন পুল নেই, সেতু নেই…।
ইত্যবসরে সুলতান আইয়ূবী সেই তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। ফৌজী সুলতানকে জিজ্ঞেস করল, মাননীয় সুলতান! আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি তো? যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?
আল্লাহ্ তাআলা শত্রুদের পরাজিত করেছেন। তোমরা বিজয়ী, হে-মা! তোমরা বিজয়ী। মা তোমাদের… সুলতান কথা শেষ করতে পারলেন না, তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, দুচোখ গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর অশ্রুধারা….।
* * *
২. জিন জযবা ও যোদ্ধা
তুর্কমান রণাঙ্গনের উত্তাপ থেমে গেল। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর কমান্ডার ও সহযোদ্ধারা মালিক আস্-সালেহ্, সাইফুদ্দীন ও গোমশতগীনের যৌথ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। বিজয়ী সৈন্যদের সামনে এখন পরাজিতদের মৃতদেহ, আর আহতদের তড়ানোর করুণ দৃশ্য। ক্ষেপা ঘোড়া, উট ও গাধাগুলো নিজেদের বাঁধনমুক্ত করতে আহত সৈন্যদেরকেই পায়ে পায়ে পিষতে শুরু করেছে। যে সব শত্রুসেনা পালাতে সক্ষম হয়নি তারা হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে এক জায়গায় জড়ো হতে শুরু করেছে। বিপুল পরিমাণ ঘোড়া, উট, তীরে ভরা তীরদান, ঢাল, তলোয়ার, বর্ম, সড়কী, তাঁবু, আহার ও সোনাদানার মতো দামী জিনিসপত্র বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোটা এলাকায়।
সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী শত্রুপক্ষের মহানায়ক সাইফুদ্দীনের বিশেষ তাঁবুতে দণ্ডায়মান। নিজ দলের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় ও আইয়ূবীর বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠার লক্ষণ দেখে সাইফুদ্দীন সৈন্য সামন্ত ময়দানে রেখেই জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। তার সাথে গেল তার কজন বিশেষ প্রশিক্ষিত নর্তকী, বিউটিশিয়ান। সাথে নিল প্রচুর নগদ মুদ্রা, সোনাদানা। যেসব সোনা দানা ও মুদ্রা সৈন্যদের বেতনভাতা হিসেবে তার কাছে ছিল রাষ্ট্রীয় আমানত।
সাইফুদ্দীনের তাঁবুটি খুব দামী শামিয়ানা এবং জড়িদার কাপড়ে তৈরী। চারদিকে কারুকার্যময় রঙ-বেরঙের নকশা। জায়গায় জায়গায় চুমকী ও মোতির দানাদার কাজ। আর তাঁবুতে ছিল বিলাসী রাজন্যবর্গের আরাম-আয়েশের সব আসবাব আয়োজন।
বিলাসী রাজা-বাদশারা যেমন আরাম আয়েশ ও মদ-নারীর আয়োজন ছাড়া এক দণ্ড টিকতে পারে না। সাইফুদ্দীনের ঘর থেকেও অনুরূপ বাহারী রঙ-বেরঙের মদভর্তি মশক বের হলো, পাওয়া গেল নানা বর্ণের ও নানা ধরনের বর্ণিল পানপাত্র।
সুলতান আইয়ূবী মনোমুগ্ধকর তাঁবু দেখছিলেন। তাঁর দৃষ্টি পালংকের উপর পড়তেই চমকে গেলেন, সাইফুদ্দীনের তরবারী পালংকের উপরে পড়ে রয়েছে! সাইফুদ্দীন এমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেল যে তরবারীটি পর্যন্ত নেয়ার অবকাশ পেল না।
আইয়ূবী তরবারীটি উঠিয়ে খাপমুক্ত করলেন। ঝিলমিলে তরবারীটি সূর্যের আলোতে চমকাতে লাগল। আইয়ূবী তরবারীটি পরখ করে দেখলেন। পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিদের ইঙ্গিত করে বললেন, মুজাহিদের তরবারীতে যখন মদ ও নারীর ছায়া পড়ে, তখন তরবারী পরিত্যক্ত লোহায় পরিণত হয়। যে তরবারী ফিলিস্তিন বিজয়ের জন্যে কোষমুক্ত হওয়ার কথা ছিল, খ্রীস্টানরা সেটাকে মদ-নারী ও পাপে চুবিয়ে বেকার বানিয়ে ফেলেছে। যে তরবারীতে একবার শরাবের ছোঁয়া লাগে সেই তরবারী শত্রু নিধনে অক্ষম হয়ে পড়ে।
সাইফুদ্দীনের রাজকীয় তাবুর পাশেই আরেকটি বিশাল সুদৃশ্য তাঁবুতে দেখা গেল কিছুসংখ্যক রূপসী যুবতী তরুণী অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। ওরা নিজেদের পরিণতি নিয়ে শংকিত। সাধারণত বিজয়ী সৈন্যরা বিজিতদের নারীদের সাথে যে ব্যবহার করে তা এসব তরুণী জানতো বলেই তাদের এতো ভয়। বিশেষ করে এসব অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণীদের দেখে বিজয়ী যোদ্ধার পক্ষে পাশবিকতার লাগাম টেনে ধরা বড়ই কঠিন। কিন্তু এসব অসহায় বিপন্ন তরুণীদের বিবর্ণ ভবিষ্যতের কালোমেঘের পরিবর্তে যখন সুলতানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো, তোমরা সবাই মুক্ত আযাদ। তোমরা যে যেখানে। যেতে চাও, বলো। তোমাদেরকে সসম্ভ্রমে, সযত্নে পূর্ণ নিরাপত্তাসহকারে ঠিকানা মতো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ঘোষণা শুনে এসব তরুণীদের চোখ ছানাভরা। এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে আরো বেশী ভড়কে গেল তরুণীরা। আইয়ূবী তরুণীদেরকে সরাসরি নিজের নিরাপত্তায় নিয়ে নিলেন। তাদের কাছে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের সংখ্যা কতো?
তারা বললো, মাত্র দুজন ছাড়া আর বাকী সবাই এখানেই রয়েছে। যে দুজন নিখোঁজ ওরা ছিল খ্রীস্টান এবং সাইফুদ্দীনের একান্ত সেবিকা। সাইফুদ্দীনের সাথেই ওরা চলে গেছে হয়তো। যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে আসা কখনও বরদাশত করতেন আইয়ূবী।
সাধারণত সেই যুগে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিজয়ী সৈন্যরা পরাজিতদের ফেলে যাওয়া রসদ ও সামগ্রী কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। সৈন্যদের একটা লক্ষ্য থাকতো পরাজিত বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘরবাড়ি ও তাঁবুগুলো কজা করা। কারণ ওগুলোতে সোনাদানা, টাকা-পয়সা আরাম-আয়েশের বিচিত্র জিনিস পত্রের সমাহার থাকে এবং বেশী প্রাপ্তির আশা থাকে। বস্তুত পরাজিত হওয়ার পর সাধারণত পরাজিত বাহিনীর কর্মকর্তাদের বাসস্থানগুলোতে বিজয়ী সৈনিকদের তাণ্ডব চলে। নারী তরুণীদের জীবন হয় বিজয়ীদের ভোগের সামগ্রী। দামী আসবাব ও তৈজসপত্র নিয়ে চলে দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতা। মোদ্দাকথা, পরাজিতের জীবনে পরাজয় বয়ে আনে ভয়ংকর কেয়ামত।