কিছুক্ষণ পর মরু ঝড়ের তীব্রতা কমতে শুরু করল। ঝড় কিছুটা থেমে এলেই কমান্ডারদের ডাকালেন সুলতান। তিনি কমান্ডারদের বললেন, তাঁবু ঠিক করার দরকার নেই, খুব তাড়াতাড়ি সৈনিকদের যুদ্ধের জন্যে তৈরী কর। গুপ্ত বাহিনীকে এখনই ডেকে পাঠাও। আইয়ূবী কমান্ডার ও সেনাকর্তাদের জানালেন, তাদের বিরুদ্ধে কি আগ্রাসন আসছে। এখন তাদের কি কি করতে হবে, মোকাবেলার ধরণ ও কৌশল কি হবে।
এক সময় ঝড় থেমে গেল বটে, কিন্তু নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল যেন দুনিয়া। আকাশে একটি তারা পর্যন্ত দেখা যায় না, আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের পর্দা।
সাইফুদ্দীনের নেতৃত্বে তিনবাহিনীর সৈন্যরা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া রসদপত্র ও তাঁবু গোছানোর কাজে লিপ্ত। সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে রাতের আক্রমণ স্থগিত ঘোষণা করল সাইফুদ্দীন। অধিকাংশ সৈন্য ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বেশীরভাগ রসদপত্র তখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অগোছালো।
কিন্তু সুলতান আইয়ূবীর শিবির কর্মমুখর। তাদের কারো চোখে ঘুম নেই। রাতের আঁধারেই আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী সাইফুদ্দীনের শিবির থেকে তিন মাইল ঘুরপথ অতিক্রম করে তাদের পিছনে অবস্থান নিল, সাইফুদ্দীন ঘুর্ণাক্ষরেও জানে না যাদের সে চিরতরে নিঃশেষ করতে বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছে, তারাই অগ্র-পশ্চাতে ঘিরে ফেলেছে তাদের।
* * *
সূর্য উঠল। দেখা গেল, সাইফুদ্দীনের বাহিনীর রসদপত্র এলোমেলো হয়ে গেছে। তাঁবুগুলো ঝড়ে উড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেছে খোঁজ নেই। ভীত-সন্ত্রস্ত উট ও ঘোড়াগুলো ঘুমন্ত সৈন্যদের পায়ে পিষে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে শুরু করেছে। দ্রুততার সাথে সাইফুদ্দীন সৈন্যদের নির্দেশ দিল সবকিছু গুছাতে। কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্র গোছাতেই তাদের দিনের অর্ধেক কেটে গেল।
সাইফুদ্দীন তিনবাহিনীর সেনা কমান্ডারদের নির্দেশ দিল যেহেতু আইয়ূবী বে-খবর তাই দিনের আলোতে মুখোমুখি আক্রমণ করেই ওদের পরাস্ত করা সম্ভব হবে।
দিনের শেষ প্রহরে সাইফুদ্দীনের নির্দেশে সুলতানের শিবিরে আঘাত হানল যৌথবাহিনী। তিনবাহিনীর সৈন্যদের অবস্থানের ডানে বামে অসংখ্য টিলা, বালিয়াড়ী ঝোঁপ-ঝাড়, ঘন বৃক্ষাদি। যেমনি সাইফুদ্দীনের নির্দেশে যৌথবাহিনী সুলতানের শিবিরে আক্রমণ করল অমনি দুপাশের টিলার ঘন গাছ-গাছালীর আড়াল থেকে তাদের উপর তীর বর্ষণ শুরু করল সুলতানের গুপ্তবাহিনী। আর সম্মুখ থেকে সুলতানের সৈন্যরা ছুঁড়তে শুরু করল অগ্নিগোলা। মিনজানিক থেকে নিক্ষেপ করলো ছোট ছোট অগ্নিযুক্ত মটকা। যা উপর থেকে মাটিতে পড়ে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সাইফুদ্দীন বাহিনীকে পশ্চাদপসারণে নির্দেশ দিল। সাইফুদ্দীনের নির্দেশে যৌথবাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করল অমনি পিছন দিকে সুলতানের ঝটিকা বাহিনী বিদ্যুৎগতিতে হামলে পড়ল। সাইফুদ্দীনের যৌথবাহিনী চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে প্রমাদ গুণতে শুরু করল। যে যেভাবে পারে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। সেনা কমান্ড ভেঙ্গে পড়ল, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিল তিনবাহিনীর মধ্যে। সাইফুদ্দীনের নিরাপত্তা বাহিনীও আক্রান্ত হল। ইত্যবসরে চারদিক আঁধার করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, রাতের আঁধারেও অব্যাহত থাকল সুলতানের সিংহ শার্দুলদের আক্রমণ।
প্রত্যূষে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সুলতান আইয়ূবী যুদ্ধের পরিস্থিতি সচক্ষে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি পদাতিক বাহিনীর কমান্ডারের কাছে দূত পাঠালেন। নির্দেশ পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে চতুর্দিক ঘিরে ফেলল অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যরা। সাইফুদ্দীনের সৈন্যরা তখন সুলতান বাহিনীর দ্বারা বেষ্টিত। গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হল, একসাথে সুলতানের সৈন্যরা শত্রুদের উপর হামলে পড়ল।
সাইফুদ্দীনের রণক্লান্ত সৈন্যরা সুলতানের সৈন্যদের প্রতিআক্রমণের দখল সামলাতে মোটেও সক্ষম হলো না। সাইফুদ্দীন নিজেও হয়ে পড়ল শঙ্কিত।
তার আহত সৈন্যরা নিজ বাহিনীর অশ্বখুরেই পিষ্ট হয়ে নিহত হচ্ছিল। আহত ঘোড়া, উট ও খচ্চরগুলো উল্টো তার বাহিনীকেই পিষ্ট করতে শুরু করল। সাইফুদ্দীন দেখল তার সৈন্যদের প্রত্যাঘাততো দূরে থাক আত্মরক্ষার শক্তিও নেই। সৈন্যদের অনেকেই অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। সুলতানের ঝটিকা বাহিনী পিছন থেকে শত্রু নিধন করে তকবির ধ্বনি তুলে সম্মুখ বাহিনীর সাথে মিলিত হচ্ছে। বস্তুত সাইফুদ্দীনের সৈন্যরা তখন একটি অনতিক্রম্য বেষ্টনিতে আটকে কচু কাটা হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিপক্ষের করুণার উপর সহযোদ্ধাদের ছেড়ে সাইফুদ্দীন জীবন নিয়ে পালাল।
সুলতানের সৈন্যরা যখন সাইফুদ্দীনের কেন্দ্রীয় কমান্ড আঘাত করে পদানত করল, তখন সেখানে পাওয়া গেল অসংখ্য মদের মটকা। সেখান থেকে যাদের গ্রেফতার করা হলো, তারা জানাল, সকালের দিকে চীফ কমান্ডারকে একটি টিলার আড়ালে দেখা গিয়েছিল, এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। ধুরন্ধর সাইফুদ্দীন যুদ্ধের পরিস্থিতি আঁচ করেই জীবন নিয়ে পালাল। যুদ্ধ শেষ হল, বিজয় হল সুলতান বাহিনীর। অবশ্যম্ভাবী একটি পরাজয় ও নিমূল আগ্রাসন থেকে সুলতানের বাহিনী রক্ষা পেল। শত্রুবাহিনী হল কুপোকাত।