আহত লোকটিই ছিল হারেস। দাউদ মৃত মনে করে চলে গেলেও আকস্মিক কঠিন আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল হারেস। ফৌজী ও তার ভাবী কয়েকটি ছোট পাত্রে পানি ভরে সাথে এনেছিল। পাত্র থেকে পানি পান করিয়ে হারেসের মুখে পানি ঝাঁপটা দিল ফৌজী। হারেস কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়ে বলতে লাগল, আমিতো ঘরে এসে পড়লাম, দাউদ কোথায়?
ফৌজী তাকে বলল, ভাইয়া, তুমি ঘরে নও, এখনো তুর্কমানের পথে, পাহাড়ে।
ফৌজী সংক্ষেপে দাউদের মৃত্যু ও তার উপর অর্পিত দায়িত্বের কথা ভাইকে জানাল এবং বলল, আমরা এখন তুর্কমানের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছি।
হারেস ফৌজীর কথা শুনে বলল, তোমরা আমাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দ্রুত তুর্কমানের দিকে ঘোড়া হাঁকাও। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
দুজনে মিলে হারেসকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল। ফৌজী একই ঘোড়ায় হারেসের পিছনে সওয়ার হয়ে ওকে এক হাতে ধরে অন্যহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরল।
হারেসের বেঁচে থাকাটা ছিল বিস্ময়কর। গভীর ক্ষত থেকে যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছে, এতে হারেসের বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু তবুও আল্লাহর বিশেষ রহমতে সে বেঁচে ছিল। ফৌজীর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে ঘোড়ার উপরে বসেছিল হারেস। ফৌজী ভাইকে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখল। ক্ষীণ আওয়াজে তাদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল হারেস।
সুলতান আইয়ূবীর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে তার শত্রুবাহিনী সাইফুদ্দীনের কমান্ডে দুর্বার গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল, আর এদিকে নিরাপদ পথ ধরে ভয়ানক আক্রমণের সংবাদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল ফৌজী ও তার ভাই-ভাবীর তিনজনের ছোট্ট কাফেলা।
এমন সময় আকাশ অন্ধকার করে ধূলি উড়তে শুরু করল। চারদিকে নেমে এলো অন্ধকার, আকাশে ঘনকালো মেঘের আবরণ। আকাশের অবস্থা দেখে ভড়কে গেল ফৌজীর ভাবী। ভীতকণ্ঠে ফৌজীকে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, দেখেছ, এটা কি? আকাশের অবস্থা দেখে ফৌজীও কিছুটা ভীত হয়ে পড়ল। হারেস জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ফৌজী?
মরুঝড়! আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ওই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে ফৌজী মরুঝড়ের সাথে পরিচিত। মরু ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কেও জ্ঞাত সে। এজন্য আকাশের অবস্থা ও ধূলিঝড়ের আশংকায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেল ফৌজী। কেননা এলাকাটি ছিল বালুকাময় ও টিলাযুক্ত। এসব জায়গায় মরু ঝড়ে এক জায়গার বালিয়াড়ী অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। ধূলি আর বালু চাপা পড়ে মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি কোথায় যে হারিয়ে যায় কোন পাত্তাই থাকে না।
সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী জানতেন না, এই মরু ঝড়ের চেয়েও প্রচণ্ড ঝড় ধেয়ে আসছে তার অজ্ঞাতে কোন জানান না দিয়ে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সম্মিলিত বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিল, ঝড় থেমে গেলে তারা সবকিছু ঠিকঠাক করে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখতে পারবে, কিন্তু বিধি বাম! ঝড়ের তাণ্ডবে সাইফুদ্দীন বাহিনীর সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। দিনের বেলায় বিশ্রামের জন্য তৈরী তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল ঝড়। সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল, অনেকে আহতও হলো। যে যেভাবে পারে পাহাড়ের টিলার আড়ালে জীবন বাঁচাতে ঠাই নিল। আর মালবাহী উট ও বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলো দড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পালাতে লাগল। এদিকে ফৌজী ঝড় উপেক্ষা করেই পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে গন্তব্যে চলছে, মৃত্যুপথযাত্রী ভাইয়ের প্রতি খেয়াল নেই তার।
* * *
সুলতান আইয়ূবীর সেনা শিবিরও ঝড়ের তাণ্ডবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমান্ডারগণ ঝড়ের মধ্যেই সিপাহীদেরকে চিৎকার করে রদসপত্র বাঁচানোর জন্যে তাকিদ দিচ্ছে। ঝড়ে উড়ে আসা কাঁকর ও বালিতে সিপাহীদের গায়ে ধূলোর মোটা আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে, উড়ে আসা কাকরগুলো যেন তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছে শরীরে। তবুও তারা নিজেদের রসদপত্র বাঁচাতে তৎপর। এই তীব্র প্রলয়ংকরী ঝড়ের মধ্যে একটি ঘোড়া কজন সিপাহীর উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। আরোহী ঘোড়াকে সামলাতে পারছে না। অবস্থা দেখে এক সিপাহী আরোহীকে চিৎকার দিয়ে বলল, আরে হতভাগা ঘোড়া থামাও! কোন্ আড়ালে যাও! ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে! ঘোড়া থামল। এক সিপাহী আরোহীকে দেখে সাথীদের বলল, আরে এ যে মহিলা! সাবধান! কিছু বলো না! অন্য সিপাহী বলল, একজন নয়। মহিলাতো দুজন দেখা যাচ্ছে।
সিপাহীরা ভাবল, ঝড়ের ধাক্কায় হয়তো পথ হারিয়ে এরা এদিকে এসেছে। তাই দুজন দুটি ঘোড়ার বাগ ধরে তাদেরকে একটু আড়ালে নেয়ার জন্য চেষ্টা করল–
সিপাহীদের তৎপরতা দেখে ঝড়ের বিকট আওয়াজকে ছাড়িয়ে গলা চড়িয়ে ফৌজী বলল, আমাদেরকে সুলতান আইয়ূবীর কাছে নিয়ে যাও, আমরা খুব জরুরী বার্তা নিয়ে এসেছি। জলদি আমাদেরকে সুলতানের কাছে নিয়ে চল; না হয় তোমরা সবাই মারা পড়বে!
কয়েকজন সিপাহী বহু কষ্টে তাদেরকে সুলতানের তাঁবুর কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু হায়! সেখানে তাঁবুর নাম-গন্ধও নেই। সব ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সুলতানের এক দেহরক্ষী এদের দেখে সুলতানের কাছে নিয়ে গেল। তবু উড়ে যাওয়ার পর সুলতান একটি স্থাপনার আড়ালে আশ্রয় নিলেন। দুজন মহিলা আরোহী এদিকে আসতে দেখে সুলতান নিজেও এগিয়ে এলেন।
সবার আগে হারেসকে ঘোড়া থেকে নামানো হল। এরপর নেমে এল ফৌজী ও তার ভাবী। তখনও জীবিত হারেস। ফৌজী অতি সংক্ষেপে সুলতানকে বলল, দাউদের বার্তা এবং শত্রুবাহিনীর আগমনের সংবাদ। হারেস ক্ষীণ কণ্ঠে সুলতানকে জানাল, দাউদ ও তার মিশনের কথা। খুব কষ্টে কথা শেষ হতে না হতেই হিমশীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল হারেস।