কতোক্ষণ এমন অবচেতন অবস্থায় ছিল বলতে পারবে না সে। কিছুটা হুঁশ ফিরে এলে অনুভব করল মানুষের স্পর্শ। তাকে ধরে রেখেছে কোন মানুষ। শত্রু কবলিত ভেবে মুক্তির আশায় উঠে দাঁড়াতে চাইল দাউদ। কিন্তু তাকে শুইয়ে দিয়ে কানে কানে কে যেন বলল, দাউদ! তুমি এখন ঘরে রয়েছ, ভয় পেয়ো না। মুমূর্ষ অবস্থায়ও ফৌজীর কণ্ঠ নির্ণয় করতে পারল দাউদ। বেহুশ অবস্থায়ই হেঁচড়ে হেঁচড়ে দাউদ ফৌজীদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। ফৌজী ও তার ভাবী অবচেতন দাউদকে সেবা শুশ্রষা ও ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিয়ে গায়ের রক্ত পরিষ্কার করে শুইয়ে রেখেছিল। দীর্ঘক্ষণ পরে হুঁশ ফেরার পর দাউদ বুঝল, ফৌজী তার কাছে, তখনই জিজ্ঞেস করল তোমার বাবা কোথায়?
উত্তরে বলল ফৌজী, তিনি এক জায়গায় গেছেন, আগামীকাল হয়তো ফিরবেন। পানি পানি………অতি কষ্টে বলল দাউদ।
ফৌজী একটি পানপাত্র ভরে পানি এনে ধরল দাউদের মুখে। ধীরে ধীরে সবটুকু পানি পান করল দাউদ। ফৌজীর হাতের পানি পান করে যেন প্রাণ ফিরে এলো দাউদের। সে বলতে লাগল ফৌজী! তুমি বলেছিলে পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে। দাউদের কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল, কথা বেরুচ্ছিল না। অনেক কষ্টে সেবারত ফৌজী ও দাউদের ভাবীকে নিবৃত্ত করতে দাউদ বলল, আমার সেবা করা অর্থহীন। আমার গায়ের রক্ত সব নিঃশেষ হয়ে গেছে, আমাকে তোমরা বাঁচাতে পারবে না। আমার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হলে তোমাদেরকে ঘরের বাইরে পাঠানোর কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু এখন বিষয়টি তোমার আমার জীবন ও মর্যাদার নয়, বিষয়টি মিল্লাতের। রাসূল (স.)-এর পবিত্র আমানতের ব্যাপার এখানে জড়িত। দাউদ তুর্কমানের পথটি ফৌজীকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলল, আলেপ্পো, মৌসুল ও হিরনের যৌথ বাহিনী রাতের অন্ধকারে আইয়ূবীর সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু আইয়ূবীর কাছে এর কোন সংবাদ নেই। তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আশংকামুক্ত মনোভাবে রয়েছেন। তোমাকে তার কাছে গিয়ে এ সংবাদ পৌঁছাতে হবে, তোমার ভাই এপথে শহীদ হয়ে গেছে।
দাউদের কথা শুনে ফৌজী তখনই তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু তার ভাবী দাউদকে এ অবস্থায় রেখে যেতে ইতস্তত করছিল, এমতাস্থায় খুব ক্ষীণকণ্ঠে ফৌজীকে কাছে ডাকল দাউদ। ফৌজী কাছে এলে তার হাত ধরে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ফৌজী! সত্যের পথের সৈনিকদের বিয়ে আসমানে হয়ে থাকে, আসমানের পথে হয় তাদের বরযাত্রা, তাদের বিয়েতে তারকারাজী আলোকসজ্জা করে…। আমাদের বিয়েতে ফেরেশতারা বরযাত্রী হবে……! এই বলে দাউদের মাথা একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল, নিথর হয়ে গেল তার দেহ। দাউদের অর্পিত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, এই অবস্থায়ই আল্লাহর উপর বাড়িঘর ছেড়ে দাউদের ঘোড়া ও আস্তাবল থেকে অপর একটি ঘোড়া এনে ননদ-ভাবী রওয়ানা হল। গমন পথ জানা ছিল না ফৌজীর। দাউদের কথার ভিত্তিতে রাতের আঁধারে আল্লাহর উপর ভরসা করে বাড়ি থেকে দুটি অবলা মেয়ে দুটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দাউদ ফৌজীকে পথের নির্দেশনা দিয়েছিল একটি তারা দেখিয়ে। সেই নির্দিষ্ট তারা লক্ষ্য করে পথ চলল ফৌজী ও তার ভাবী। যে মেয়ে কোনদিন বাড়ির বাইরে যায়নি, সেই কিশোরীই আজ রাতের আঁধারে নির্বিক, নিঃশঙ্ক।
ওদিকে যৌথবাহিনী সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে রাতের আঁধারে আবারো অগ্রসর হতে লাগল। তুকমান তেমন বেশী দূরে নয়। কিন্তু আইয়ূবী আসন্ন আগ্রাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। তিনি গোয়েন্দা ব্যবস্থা বহাল রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু শত্রু পক্ষ এবার তার গোয়েন্দা তৎপরতাকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। এদিকে তিনি সেনা অফিসারদের কাছেও বলছিলেন, মনে হয় না সাইফুদ্দীনরা পুনর্বার তাড়াতাড়ি আক্রমণের সাহস পাবে। অথচ তিনি সাইফুদ্দীনের উদ্দেশে পাঠানো মালিক আস-সালেহ এর চিঠি ঠিকই পেয়েছিলেন। তবুও তার মনে হচ্ছিল এরা এতো তাড়াতাড়ি আক্রমণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে না। এজন্য সালাহ্ উদ্দীন সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ আশংকা থেকে। যার ফলে যৌথবাহিনী তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে ও অপ্রস্তুতিতে রাতের আঁধারে আক্রমণ করে তাকে বেহাল করে দিতে সক্ষম হতো।
* * *
ফৌজী ও তার ভাবী দাউদের অর্পিত কর্তব্য পালনে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল যে, তারা যে নারী, পথে তাদের পদে পদে বিপদ, শংকা, আর সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে একথা ভুলেই গিয়েছিল। রাত পেরিয়ে সূর্যের আলো উঠা পর্যন্ত তারা দেখে দেখে অবিরাম পথ অতিক্রম করল ফৌজী। সকালের সূর্য যখন চারদিকে আলোকিত করে উদিত হল, তখন তারা পৌঁছে গেল সেই বালিয়াড়ী, টিলা ও ঝোঁপঝাড়ের এলাকায় যেখানে দাউদ ও হারেস আক্রান্ত হয়েছিল শত্রু বাহিনীর দ্বারা। ফৌজী দেখতে পেল একটি টিলার পাদদেশে একজন লোক যেন বসে রয়েছে। ফৌজী তার ভাবীকে বলল, মনে হয় কোন আহত জখমী ব্যক্তি। কিন্তু জানাতো নেই কে, কাজেই কাছে যাবো না। তাদের গমন পথ ছিল লোকটির পাশ ঘেঁষে, কিন্তু তারা ঘোড়া কিছুটা দূর দিয়ে নিতে সচেষ্ট হল। এমতাবস্থায় আহত লোকটি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল সে দাঁড়াতে পারছে না, তার শরীর রক্তে রঞ্জিত। তারপরও লোকটিকে পরখ করে নেয়ার জন্য গতি বাড়িয়ে কিছুটা কাছ দিয়েই যেতে লাগল ফৌজী। লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে ফৌজী চিৎকার দিয়ে উঠল, হায় আল্লাহ্! ভাইয়া! এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে এল ফৌজী।