দাউদ ও হারেস উন্মুক্ত ময়দানের দিকে বেরিয়ে এল। তারা যখন ভাবল যৌথ বাহিনী থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে গেছে; তখন তাদের ঘোড়াকে তুকমানের পথে ঘুরিয়ে দিল এবং ঘোড়া তীব্র বেগে ছুটানোর পরিবর্তে ধীরে ধীরে চালাতে লাগল।
তারা খুব দ্রুতবেগে ঘোড়া না ছুটিয়ে ধীরে সুস্থে যেতে লাগল, যাতে বিরতিহীনভাবে এক নাগাড়ে যেতে পারে। রাত শেষে ভোরের আলো যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল, তখন দাউদ ঘোড়া থেকে নেমে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে যৌথ বাহিনীর গমন পথ দেখতে লাগল। কিন্তু দাউদের দৃষ্টিতে যৌথ বাহিনীর গমন পথের ধূলো ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে দাউদ ভাবল, তারা দুশমন থেকে নিরাপদ।
নিরাপদ ভাবাটাই ছিল দাউদের বড় ভুল। টিলার উপর দাঁড়ানো অবস্থায় দুশমনদের দৃষ্টি পড়ল তাদের উপর। কারণ এলাকাটি ছিল ঘন বালিয়াড়ী আর টিলায় ভরা। টিলা থেকে নেমে দাউদ ও হারেস তীব্র বেগে ঘোড়া হাঁকাল। কয়েকটি টিলা পেরিয়ে একটি সংকীর্ণ গিরিপথে বাঁক নিতে গেল দাউদ ও হারেস। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের পথ আগলে দাঁড়াল চারজন অশ্বারোহী। হাতে তাদের উন্মুক্ত তরবারী, উত্তোলিত বর্শা। অশ্বারোহীরা ঘিরে ফেলল দাউদ ও হারেসকে। ধমকের স্বরে বলল, ঘোড়া থেকে নেমে তরবারী ফেলে দাও। পালানোর চেষ্টা করলে বাঁচতে পারবে না।
আমরা মুসাফের, আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালে কেন? বলল দাউদ।
মুসাফের মৌসুল সেনাবাহিনীর উর্দি পরিহিত থাকে না বলল এক অশ্বারোহী। মুসাফেরদের সাথে এমন অস্ত্র ও থাকে না, যে অস্ত্র তোমাদের কাছে রয়েছে। তোমরা যেই হও না কেন, তোমাদের আলেপ্পো যেতে হবে, ঘোড়া ঘুরিয়ে ফেল।
এরা ছিল আলেপ্পো বাহিনীর গুপ্তচর। এরা সন্দেহভাজন লোকদের গ্রেফতার করে কর্তাদের নির্দেশ মতো আলেপ্পো নিয়ে যেতো। বিগত যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দা তৎপরতা নস্যাৎ করে দিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে খ্রীস্টান উপদেষ্টারা।
দাউদ হারেসকে অনুচ্চকণ্ঠে বলল, ভাই! সময় এসে গেছে, শেষ চেষ্টা করতে হবে। হারেস নিজ ঘোড়ার লাগাম ধরে হেচকা টান দিলে ঘোড়া সামনে দুপা উঁচু করে দাঁড়াল, আর হারেস সম্মুখের অশ্বারোহীকে বর্শা বিদ্ধ করল কিন্তু ইতিমধ্যে পাশের অশ্বারোহীর বর্শা এসে হারেসের কাঁধে পড়ল। দাউদ ছিল গুপ্ত ও ঝটিকা আক্রমণে পারদর্শী। সে হঠাৎ ঘোড়াকে ঘুরিয়ে এক অশ্বারোহীকে হত্যা করে ফেলল। কিন্তু শত্রু চারজন আর এরা মাত্র দুজন। তাছাড়া জায়গাটি ছিল সংকীর্ণ। অশ্বযুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অনুপোযোগী। তদুপরি দাউদ এদের তিনজনের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হল। দীর্ঘক্ষণ চলল বর্শা ও তরবারীর ঝনঝনানি আর ঘোড়ার লম্ফ ঝম্ফ। হারেসের আঘাত ছিল খুবই গভীর। বেশী রক্তক্ষরণে সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল। তিনজনের মোকাবেলা করতে গিয়ে দাউদও আহত হলো মারাত্মকভাবে। তারপরও সে বোধ ও চিন্তাশক্তি স্থির রাখতে সক্ষম হল। এক পর্যায়ে সব শত্রুই দাউদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। দাউদের আঘাতে আঘাতে নিস্তেজ ও নীরব হয়ে গেল সব ঘাতক। দাউদ যখন দেখল যুদ্ধ খতম তখন হারেসের গ্রামের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। যদিও ঘোড়া হাঁকানোর মতো শক্তি তার গায়ে ছিল না, তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে হারেসের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে শত্রু বাহিনী আক্রমণের আগে সংবাদটা আইয়ূবীর কাছে পৌঁছানোর কর্তব্য পালনে ব্রতী হল দাউদ।
হারেসের প্রতি তাকানোর অবকাশ রইল না তার। কেননা হারেসের শরীর নিথর হয়ে পড়েছিল, সে ধারণা করেছিল হারেস ইতিমধ্যেই প্রাণ ত্যাগ করে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেছে। দাউদের নিজের প্রাণও ওষ্ঠাগত। বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। তবুও চাচ্ছিল কোন মতে হারেসের বাবার কাছে পৌঁছে বলবে, শহীদ সন্তানের মর্যাদা রক্ষায় তিনি যেন আইয়ূবীর কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হন। তুর্কমান ছিল অনেক দূর। তদপেক্ষা হারেসের গ্রাম কাছে; তাই হারেসের গ্রামের উদ্দেশেই ঘোড়া ছুটাল আহত দাউদ।
দাউদের শরীর শত্রুদের বর্শার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ঘোড়ার জীন ও পিঠ রক্তে লাল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। তবুও শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাবুক হানল দাউদ। ঘোড়া যতো তীব্র ছুটতে লাগল ঝাঁকুনি খেয়ে দাউদের শরীর থেকে ততই বেশী রক্ত বেরিয়ে যেতে লাগল। রক্তক্ষরণের কারণে তার মাথা চক্কর দিতে লাগল। বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চোখে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করল। ঘোড়ার পিঠে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে চেষ্টা করল দাউদ। কিন্তু প্রাণবায়ু যেন উড়ে যেতে উদ্যত। আর ঘোড়ার পিঠে বসে থাকার শক্তি পাচ্ছে না সে। আসমানের দিকে তাকিয়ে বারবার। কালেমা তাইয়্যেবা পড়ছিল আর বলছিল, হে আসমান ও যমীনের মালিক! তোমার রাসূলের দোহাই! আমাকে আরেকটু সময় জীবন ভিক্ষা দাও, আমার কর্তব্য পালনের সুযোগ দাও! ঘোড়া উধশ্বাসে হারেসের বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। এক সময় মাথা ঘুরে পড়েই গিয়েছিল প্রায়, কোন মতে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বপিঠের উপর পড়ে রইল দাউদ।
পুনর্বার ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ল শরীর। ঘোড়ার শরীর জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা করল দাউদ, কিন্তু পারল না। দ্রুত ধাবমান অশ্বপিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ল নীচে। অনুধাবন করল তার শরীর মাটি স্পর্শ করেছে। দুচোখে নেমে এল অন্ধকার।