এ সংবাদ যখন মালিকের খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের কানে গেল তখন তারা এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিল, হয়তো প্রেরিত দূত নিজেই ছিল আইয়ূবীর গোয়েন্দা, নয়তো দূত আইয়ূবীর গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে নিহত হয়েছে। এই ঘটনার পরিণতি এই হতে পারে যে, আইয়ূবী প্রস্তুতি দ্রুত করছে, অথবা দ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তোমাদের প্রয়োজন তিনবাহিনী একত্রিত করে এখনই আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করা।
খ্রিস্টানরা চাচ্ছিল মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি লড়াই অব্যাহত থাকুক। সে লক্ষ্যে পরদিন হিরনে ও মৌসুলে পয়গাম পাঠানো হল, সৈন্যরা যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থাতেই আলেপ্পো পৌঁছাতে। হিরনের গভর্নর গোমশতগীন এক্ষুণই আক্রমণে সম্মত ছিল না, নানাভাবে সে তাৎক্ষণিক আক্রমণে তার বাহিনীকে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছিল না, কিন্তু যৌথ বৈঠকে বসে তার পক্ষে আর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রম করা সম্ভব হলো না। বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হলো যে, তিনবাহিনী একক হাই কমান্ডের অধীনে থাকবে। আর সুপ্রীম কমান্ডার থাকবে সাইফুদ্দীন। গোমশতগীন তার সৈন্যবাহিনী দিল বটে কিন্তু নিজে আলেপ্পোতেই অবস্থান করল। সাইফুদ্দীনের অধীনে যুদ্ধ করতে সে যে মোটেও ইচ্ছুক নয় তা পরিষ্কার হয়ে উঠল।
তিন দিনের মধ্যে আলেপ্পো, হিরন ও মৌসুলের সৈন্যরা একত্রিত হয়ে গেল। খ্রিস্টানরা পূর্ব থেকেই যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য রসদের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তদুপরি আরো বেশী রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সৈন্যদের অভিযানে পাঠিয়ে দিল।
ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরী হল। আরো বলা হল, তিন বাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর যাতে আইয়ূবী না পেতে পারে সে জন্য শুধু রাতের বেলায় সৈন্যরা অগ্রসর হবে আর দিনের বেলায় যাত্রা বিরত রাখবে। তা ছাড়াও ডানে বামে অগ্রভাগে গোয়েন্দা দল ও গুপ্তবাহিনীকে নির্দেশ দিল, পথের আশেপাশে কোন মুসাফের পাওয়া গেলেও তাকে গ্রেফতার করে আলেপ্পোয় পাঠিয়ে দিতে, যাতে কোন অবস্থাতেই প্রতিপক্ষ তিন বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে অবহিত হতে না পারে।
অভিযান শুরুর আগে সাইফুদ্দীন দাউদ ও হারেসকে ডেকে সাধুবাদ দিয়ে বলল, তোমরা কঠিন সময়ে আমাকে সঙ্গ দিয়েছো, এজন্য তোমাদেরকে ধন্যবাদ। অবশ্যই যুদ্ধের পরে তোমাদের পদায়ন করা হবে এবং পুরস্কৃত করা হবে। সাইফুদ্দীন হারেসকে বলল, তোমার বোনের একটি ঋণ আছে আমার উপর। আমি তার সামনে সেদিনই যাব যেদিন তার সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করতে পারব। হারেসের বিস্ময়ে সাইফুদ্দীন বলল, ফৌজী আমাকে বলেছিল, আইয়ূবীকে পরাজিত করে তার তরবারী নিয়ে যেতে পারলে সে আমার সাথে চলে আসবে। হারেস! আমি বিজয়ী বেশে ফিরে এলে তোমার বোন মৌসুলের রাণী হবে।
ইনশাআল্লাহ্! আল্লাহ্ আপনার আশা পূরণ করবেন। আচ্ছা তিন বাহিনী কি এক সঙ্গে যাচ্ছে?
হ্যাঁ। আমিই তিন বাহিনীর চীফ কমান্ডার।
জিন্দাবাদ। এবার হয়তো আইয়ূবীর পালানোর পালা। বলল দাউদ।
দাউদ ও হারেস চরম আনুগত্যের অভিনয় করে এবং ফৌজীর কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে নারীলোভী সাইফুদ্দীনের কাছ থেকে তিন বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা জেনে নিল।
এরপর সাইফুদ্দীন বলল, তোমরা দুজন এখন নিজ নিজ বাহিনীতে চলে যাও। আমার দেহরক্ষী এসে পড়েছে। তোমাদের কথা আমি স্মরণ রাখব। এদিকে তিনবাহিনী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে তার অজ্ঞাতসারে পরাজিত করতে এগিয়ে চলল আলেপ্পোয়।
রাতের বেলায় শুরু হল তিন বাহিনীর যৌথ অভিযান। দাউদ ও হারেস মৌসুলের সেনাবাহিনীর সাথে মিশে গেল। হারেস মৌসুল সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈনিক হওয়ার কারণে অনেকেই তাকে চিনতো। কিন্তু দাউদ ছিল অপরিচিত মুখ। সন্দেহ নিরসনের জন্যে হারেস নিজেই দাউদ সম্পর্কে সৈনিকদের বলল, সে গভর্নরের প্রেরিত লোক। চলার পথে দাউদ সম্পর্কে কেউ আর তেমন ঘাটাঘাটি করল না। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন বাহিনীর সৈন্য অগ্রসর হতে লাগল। অধরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর বাহিনী পাহাড়ী উঁচু-নীচু গিরিখাদ অতিক্রম করতে গিয়ে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ল। এই সুযোগে দাউদ হারেসকে বলল, পালানোর এই তো সুযোগ, সুযোগ বুঝে দল থেকে কেটে পড়তে হবে। রাতের আঁধার ও দুর্গম পথের বন্ধুরতার সুযোগে উভয়েই তাদের ঘোড়া দল থেকে পিছু হটিয়ে আড়াল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। দাউদের ইচ্ছা ছিল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই উধশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। দিনের বেলায় যখন তিন বাহিনীর অগ্রাভিযান থেমে যাবে ইত্যবসরে তারা এদের খবর নিয়ে তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবে। একদিন আগেই সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী আক্রমণের সংবাদ পেয়ে মোকাবেলার আগাম প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবেন।
দাউদ মনে করেছিল তার পরিকল্পনায় ত্রুটি নেই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর উপদেষ্টাদের অতিরিক্ত সতর্কতা ও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে দাউদের কোন ধারণা ছিল না। দ্রুপ এই অঞ্চলের ভৌগোলিক দুর্গমতা সম্পর্কেও দাউদ অবগত ছিল না। শত্রু বাহিনী তাদের আশপাশের তিন মাইল পর্যন্ত গুপ্ত বাহিনী ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। দুর্গম পথের ঝোঁপ ঝাড়ে ঘাতকবাহিনী সন্দেহভাজনদের গতিবিধি ওঁৎ পেতে থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল। এ বিষয়টি ঘুণাক্ষরেও দাউদের জানা ছিল না।