সেই কনফারেন্সেই সিদ্ধান্ত হলো, যে করেই হোক তিন বাহিনীকে আলেপ্পোয় একত্রিত করে এক কমান্ডের অধীনে পুনর্বার যুদ্ধে পাঠাতে হবে এবং সেই সাথে তিনবাহিনীর মধ্যে প্রয়োজনে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির সুযোগও রাখতে হবে।
* * *
রাতের দ্বিপ্রহর। আস্তাবল থেকে বের করা হলো তিনটি ঘোড়া। একটিতে সওয়ার হলো সাইফুদ্দীন, একটিতে হারেস ও অপরটিতে দাউদ। দাউদ ও হারেসের হাতে বর্শা। সৈনিকসুলভ সতর্কতা তাদের মধ্যে। ফৌজী, তার ভাবী ও বৃদ্ধ পিতা তাদের বিদায় জানাতে গেটের বাইরে দাঁড়ানো। হারেসের হাতে মশাল। সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি নিবদ্ধ ফৌজীর দিকে। আর ফৌজী দাউদের ঘোড়ার পাদানী বেঁধে দেয়ার কাজে মগ্ন। বিদায়লগ্নে ফৌজী দাউদের প্রতি নিজের মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ভাই ও সাইফুদ্দীনের উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করল না। একটু পরে আল্লাহ্ হাফেয়, আল্লাহ হাফেয ধ্বনি উচ্চারিত হলো সবার মুখে। অশ্বারোহী তিনজন নিমিষের মধ্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
দীর্ঘক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ফৌজী ও তার ভাবী। যতক্ষণ অশ্বক্ষুরের আওয়াজ কানে ভেসে আসছিল ততক্ষণ তারা কান পেতে রইল সেদিকে।
অশ্বের আওয়াজ যত ক্ষীণ হতে থাকল ফৌজীর হৃদয় মন ততই বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তার কানে কেবল ধ্বনিত হলো দাউদের কণ্ঠস্বর। সত্যপথের সৈনিকদের শাদী আসমানে হয়ে থাকে। তাদের বাসর হয় আকাশের গ্রহে গ্রহে। তারকারা তাদের বিয়েতে আলোজসজ্জা করে ……….
আনমনে ননদ-ভাবী ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল কিন্তু ফৌজীর কানে আরো উচ্চকিত হতে থাকল দাউদের সেই কণ্ঠ…….. হঠাৎ ফৌজীর মনে উঁকি দিল একটা প্রশ্ন। আমি কি দাউদকে বিয়ে করতে চাই? মনে হতেই লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল, অন্ধকারের মধ্যেও উড়নায় মুখ ঢেকে ফেলল ফৌজী। পরক্ষণেই তার স্মরণ হলো দাউদের আরেকটি কথা–আমাদের সামনে এখন বিশাল রক্ত ফোরাত, সেখানে নেই কোন পুল, কোন সাঁকো। একথা স্মরণ হতেই দেহের রক্ত টগবগিয়ে উঠল ফৌজীর। বিয়ে ও বাসরসজ্জার স্বপ্ন কর্পূরের মতো উবে গেল, ফৌজীর সারা শরীর কঠিন হয়ে উঠল।
সারারাত সাইফুদ্দীন, হারেস ও দাউদ ঘোড়া হাঁকাল। বেলা উঠার পর দাউদ ও হারেস থেকে কিছুটা আগে আগে চলল সাইফুদ্দীন। দাউদ ও হারেস ইচ্ছে করেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগল আর পরস্পর কথা বলতে লাগল। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ও দূরত্বের কারণে সাইফুদ্দীন তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না।
আমি বুঝতে পারছি না, তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? ক্ষুব্ধ স্বরে বলল হারেস। এখানে ওকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেললে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
ওকে জীবিত রেখে ওর গোটা বাহিনীকেই আমি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। বলল দাউদ। শুধু একে হত্যা করলে কি হবে তার বাহিনীর কমান্ড আর কেউ নিশ্চয়ই হাতে নেবে। তাই আমার ইচ্ছা এর উদ্দেশ্য অবগত হয়ে ওদের সম্পূর্ণ শিকড় সমূলে উৎখাত করা। শুধু খোঁচা দিয়ে সতর্ক করা নয়। তুমি দয়া করে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখ। দেখ না আমি কি করি।
দুপুরের আগেই ওদের গোচরিভূত হলো আলেপ্পো শহরের সুউচ্চ মিনার। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল আল-মোবারক হ্রদের তীরবর্তী সুশোভিত উদ্যান। হ্রদের কাছে পৌঁছলে সাইফুদ্দীনের প্রেরিত কমান্ডার দৌড়ে এসে জানাল, মালিক আস্-সালেহ সাইফুদ্দীনের সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করছেন। আল মোবারক উদ্যানে পৌঁছালে মালিকের দুজন অফিসার সাইফুদ্দীনকে অভিবাদন করল। সাইফুদ্দীন বলল, সে এখন প্রাসাদে যাওয়ার চেয়ে এ হ্রদের পাশেই অবস্থান করতে আগ্রহী। অতএব, তাকে যদি এখানে তাঁবু খাঁটিয়ে দেয়া হয় সেটিই হবে তার পছন্দনীয়। সাইফুদ্দীনের আগ্রহে হ্রদের তীরবর্তী উদ্যানে প্রাসাদ সদৃশ তাঁবু খাঁটিয়ে দিতে অল্প সময়ের মধ্যে রাজ কর্মচারীরা লেগে গেল। রাজ প্রাসাদ থেকে সকল আরাম-আয়াশের সরঞ্জামাদির ও সেবার আয়োজনও করা হল। সাইফুদ্দীন দাউদ ও হারেসকে নিজের সাথেই রাখল। রাতে মালিকের পক্ষ থেকে প্রাসাদে নৈশভোজের দাওয়াত করা হল সাইফুদ্দীনকে এবং বলা হল সেই দাওয়াত ও মোলাকাত পর্বে উভয়ের মধ্যে কথা হবে।
* * *
সন্ধ্যায় মালিক আস-সালেহ ও সাইফুদ্দীনের বৈঠক হল। আল-মালিক সাইফুদ্দীনকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাল। সাইফুদ্দীন কিশোর মালিকের হাতে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেলল। বৈঠকে আলোচনা ও নৈশভোজের পর সাইফুদ্দীন তার জন্যে তৈরী বিশেষ তাবুতে ফিরে গেল এবং ওখানেই অবস্থান করল।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, সাক্ষাতে সাইফুদ্দীন মালিককে আইয়ূবীর সাথে কৃত চুক্তি সম্পর্কে তার উদ্বেগ ও প্রেরিত পয়গামের প্রতিউত্তর না দেয়ার কথা উত্থাপন করলে মালিক বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, না! আমি পরদিনই দূত মারফত লিখিত জবাব দিয়েছি। কিন্তু আপনার কাছে না পৌঁছার ব্যাপারটি আমার মোটেও জানা নেই। আমি সেখানে লিখেও দিয়েছি, আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না, চুক্তির ব্যাপারটি সম্পূর্ণই একটি সময়ক্ষেপণের কৌশলমাত্র।
আপনার কোন পয়গাম আমার কাছে পৌঁছেনি। বলল সাইফুদ্দীন। আমিতো এ নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম এই ভেবে যে, আপনি আইয়ূবীর সাথে সন্ধিচুক্তি করে আমাদের ধোকা দিয়েছেন এবং এটা আপনার জন্যে হবে মারাত্মক ভুল। বৈঠকে মালিকের দুজন সেনা অফিসারও ছিল। পয়গাম না পৌঁছার খবরে তাৎক্ষণিক তারা খোঁজ খবর শুরু করল দূতের। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যে দূতকে পয়গাম দিয়ে পাঠানো হয়েছিল সেদিন রওয়ানা হওয়ার পর আর তাকে এখানে দেখা যায়নি। এরপর বহু তালাশ করেও দূতের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। জানা গেল পয়গামবাহী দূত কখনও সেনা শিবিরে থাকতো না। সে একাকী দূরে থাকতো। কোথায় থাকতো তা কেউ জানতো না। এটা কেউ ধারণা করতে পারেনি যে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়গাম আইয়ূবীর কাছে পৌঁছে যেতে পারে।