আমীরে মুহতারাম! আল্লাহ্ আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। আপনিই ভালো জানেন এখন কি করতে হবে। আমরা আপনার হুকুমের গোলাম মাত্র। যা হুকুম করবেন তাই শিরোধার্য করে নেবো। তবে অধমের খেয়াল এই যে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যদের যুদ্ধের সাহস নেই। আপনি যদি সৈন্যদের একত্রিত করে এখনই হামলা করেন, তবে আইয়ূবীকে আপনি দামেস্ক পৌঁছে দিতে পারেন।
সাইফুদ্দীন দাউদের বক্তব্য তন্ময় হয়ে শুনছিল। কারণ সে ছিল পরাজিত। বিজয়ের আশ্বাসবাণী শোনার জন্যে উদগ্রীব ছিল সাইফুদ্দীন। সে শুনতে চাচ্ছিল তার পরাজয় হয়নি। তার সৈন্যরাও পালিয়ে আসেনি। জোটের শরীকরা ভড়কে গিয়ে তাকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। দাউদ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। দাউদ পাকা গোয়েন্দা। সে বুঝতে পেরেছিল সাইফুদ্দীন কোন্ ধরনের কথায় মুগ্ধ হবে।
আমরা মৌসুল যাচ্ছিলাম। হারেস বলল, পাশের গ্রামেই আমার বাড়ি। সে বাড়ির লোকদের সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করল। তাই ওর সাথে এখানে এলাম। এখানে এলে হারেসের আব্বা বললেন, আপনি এখানে। আছেন। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আপনাকে দেখেও প্রথমে আমি বিশ্বাস। করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কোন ভুল দেখছি না তো? আল্লাহ্ আমাদের উপর বড় দয়া করেছেন। এ কথাগুলো আপনার কাছে পৌঁছানো জরুরী ছিল। আল্লাহ মেহেরবানী করে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তোমাদের কথা শুনে আমি খুবই প্রীত হলাম। রাজকীয় রীতিতে বলল সাইফুদ্দীন। তোমাদের এই বীরত্বের জন্যে পুরস্কার দেয়া হবে।
আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কি পুরস্কার হতে পারে, আমরা আপনার পাশাপাশি বসে আপনার সাথে কথা বলতে পারছি। বলল হারেস। আমরা আপনার সেবায় জীবন দিয়ে আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করতে প্রস্তুত।
শুনলাম আপনার সাথে আরো কারা নাকি আছে? জিজ্ঞেস করল দাউদ।
ওরা দুজন চলে গেছে। আমিও একটু পরেই এখান থেকে রওয়ানা হবো। বলল সাইফুদ্দীন।
আপনাকে জিজ্ঞেস করা ধৃষ্টতা হবে যে, আপনি এখানে কেনই বা যাত্রা বিরতি করলেন, আর এখন কোথায় যাবেন? আমি খুব লজ্জিত যে, আপনাকে আমার লোকেরা এই পুঁতিগন্ধময় ঘরে এ বিছানায় রেখেছে। বলল হারেস।
আমি নিজেই এ ঘরটি বেছে নিয়েছি। এখানে কয়েকদিন থাকার দরকার ছিল আমার। তোমরা আমার এখানে অবস্থানের কথা কাউকে বলো না।
এখন আপনি কোথায় যাবেন? জিজ্ঞেস করল দাউদ।
আগে আমি আলেপ্পো যাবে। এরপর ওখান থেকে মৌসুল চলে যাবো। বলল সাইফুদ্দীন।
কিন্তু আপনি যে একাকী। আপনার সাথে কোন দেহরক্ষী নেই তো? বলল দাউদ।
এ অঞ্চলে কোন ভয় নেই। একাকীই চলে যেতে পারব। বলল সাইফুদ্দীন।
অপরাধ ক্ষমা করবেন। বলল দাউদ। এ অঞ্চলকে দুশমন শূন্য মনে করবেন না। আমি যতটুকু জানি, আপনি হয়তো অতোটা জানেন না। আইয়ূবীর গুপ্তবাহিনী এ অঞ্চলেও রয়েছে। হঠাৎ কেউ যদি আপনাকে চিনে ফেলে তবে সারাজীবন আমরা দুজন আফসোস করে মরব, কেন আপনার নিরাপত্তার জন্যে সঙ্গী হলাম না আমরা। ঘটনাক্রমে আমরা যেহেতু এসে গেছি, আর আমাদের সাথে ঘোড়াও আছে, হাতিয়ারও রয়েছে, আমরা আপনার সাথে যাবো। আপনার মতো কোন শাসক নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া একাকী যাওয়া ভালা দেখায় না।
দেহরক্ষীর প্রয়োজন অনুভব করছিল সাইফুদ্দীন। কেননা এমনিতেই যে ভীতু ছিল, দাউদ তাকে আরো ভয় পাইয়ে দিল। সে তাদের বলল, তোমরা কাপড় চোপড় ধুয়ে নাও এবং আগামী রাতে রওয়ানা হওয়ার জন্যে তৈরী হও। ওরা বিদায় নিয়ে ঘরে চলে গেলে সাইফুদ্দীন ফৌজীর আগমন প্রত্যাশায় অধীর হয়ে রইল। কিন্তু সে রাতে ফৌজী আর সাইফুদ্দীনের ঘরে পা বাড়াল। দিনের বেলায় দাউদ ও হারেস সাইফুদ্দীনের জন্য খাবার নিয়ে গেল। এভাবেই ফৌজীর দেখা না পেয়েই কেটে গেল দিন।
* * *
জাতিদ্রোহী তিন শাসক সাইফুদ্দীন, গোমশতগীন ও মালিক যখন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে পুনর্বার যৌথ আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল, ঠিক সে সময় ওদের থেকে কিছু দূরে খ্রিস্টান সেনা অফিসার, কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের কনফারেন্স চলছে। সেখানে পর্যালোচনা হচ্ছে, তিন বাহিনীর পরাজয়ের কারণ। মূলত এরা সবাই ছিল পরাজিত। পরাজয় পর্যালোচনা এবং এর কারণ অনুসন্ধানই ছিল কনফারেন্সের মূল লক্ষ্য।
তিন বাহিনীর পরাজয় প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরাজয়। বলল রিমান্ড। আমি যতদূর জানি, তিন বাহিনীর মোকাবেলায় আইয়ূবীর সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল না।
আপনার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। বলল ফরাসী শাসক রেনাল্ট। আমাদের উদ্দেশ্য ওদের জয় পরাজয় নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হলো, মুসলিমরা পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত থাকুক আর একটি পক্ষ আমাদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করুক। আমাদের প্রধান শত্রু আইয়ূবী। আমরা চাই, ওর মুসলিম ভাইয়েরা ওর বিপক্ষে লড়াই করে ওর শক্তি বিনষ্ট করুক। আইয়ূবীর প্রতিপক্ষ মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। এমনও হতে পারে যে, আইয়ূবীকে পরাজিত করতে পারলে ওর প্রতিপক্ষ মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে পড়বে।
আমি আপনাকে মুসলিম বাহিনী ও এ অঞ্চলের বিস্তারিত রিপোর্ট দিচ্ছি। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দারা এ রিপোর্ট পাঠিয়েছে। বলল এক ইহুদী কর্মকর্তা। তারা লিখেছে–সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর প্রতিপক্ষ তিন বাহিনীর সৈন্যদের অবস্থা এমন যে, সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ করার সাহস মোটেও নেই। ওরা সাহস হারিয়ে ফেলেছে। রণাঙ্গনে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্রও ফেলে পালিয়েছে। এক্ষুণি এরা পুনর্বার যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত নয়। আমাদের যেসব উপদেষ্টা তিনবাহিনীতে কাজ করছে বহু কষ্ট করে তাদেরকে আইয়ূবী বিরোধী যুদ্ধে সম্মত করিয়েছিল। বর্তমানে আইয়ূবী তুর্কমান অঞ্চলের সবচেয়ে উর্বর ময়দানে তাঁবু গেড়েছে। এক্ষুণি অগ্রাভিযানের অভিপ্রায় তার নেই বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের উপদেষ্টাগণ চেষ্টা করছে মৌসুল, হিরন ও আলেপ্পোর বাহিনীর অবস্থা যাই থাকুক যাতে তড়িৎ আক্রমণে ওদের সম্মত করানো যায়। আমার বিশ্বাস, এক্ষুণি হামলা করতে সক্ষম হলে আইয়ূবীর অজ্ঞাতে আকস্মিক হামলা করে তাকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে। আইয়ূবীকে পরাজিত করার এটা একটা মোক্ষম সুযোগ।