আপনার আবার আলেপ্পো যাওয়া উচিত। কমান্ডারের উদ্দেশে বলল ডিপুটি। আমি মৌসুল যাচ্ছি।
তুমি আবারও আলেপ্পো যাও। গিয়ে মালিক আস্-সালেহকে বলো আমি আসছি। কমান্ডারকে বলল সাইফুদ্দীন। তুমি আজ রওয়ানা হলে আগামীকাল রাতেই আমি রওয়ানা হবো। সে হয়তো আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজী হবে না। বলবে শহরের বাইরে আল-মোবারক নদীর তীরে আমি থাকবো। সেখানে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে। যদি সে সাক্ষাতে রাজী না হয় তবে তুমি এসে আমাকে খবর বলো।
আপনার একাকী যাওয়া কি ঠিক হবে? বলল ডিপুটি।
এ অঞ্চলে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া আমি যাবো রাতের বেলায়। তখন কে জানবে মুসৌলের গভর্নর যাচ্ছে?
সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর গোয়েন্দা আর গুপ্তচর আমাদের এলাকায় চষে বেড়ায়। কখন কি থেকে কি ঘটে যায় বলা যায় না। বলল ডিপুটি।
বিপদের আশঙ্কা থাকলেও আমাকে যেতে হবে। ঝুঁকি তো কিছুটা নিতেই হবে। তুমি আজ মৌসুল চলে যাও। আমি আগামী রাতেই রওয়ানা হবো।
ওরা যখন এসব কথাবার্তা বলছিল, তখন দাউদ ও হারেছ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। এতটুকু শুনেই উভয়ে ঘরে ফিরে এল। দাউদ গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। ভাবল যে করেই হোক সাইফুদ্দীনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব এই ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিল না দাউদ। অবশেষে দাউদের মাথায় একটা পরিকল্পনা এল।
আমরা সাইফুদ্দীনের দেহরক্ষী হিসেবে তার সঙ্গী হব। হারেসকে বলল দাউদ। হঠাৎ আমরা তার মুখোমুখি হয়ে বলব, আমরা মৌসুলের সৈনিক।
সে যদি বলে বসে, আমার সাথে তোমাদের যেতে হবে না, তোমরা মৌসুল চলে যাও। তখন কি করবে?
তখন আমি আমার কথার যাদু চালিয়ে পরিস্থিতি বাগে আনার চেষ্টা করব। বলল দাউদ।
তোমার সেই কৌশলেও যদি কাজ না হয়?
যদি দেখি কোন মতেই সে আমাদের সাথে নিতে রাজী হচ্ছে না তবে তাকেও যেতে দেয়া হবে না। কারণ সাইফুদ্দীন যাবে মালিক আস্-সালেহ-এর কৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করাতে। দাউদ হারেসকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তখন সে কি করবে।
সে রাতে সাইফুদ্দীন কমান্ডার ও ডিপুটিকে শেষ পরামর্শ দিচ্ছিল। রাতের প্রথম প্রহরে কমান্ডার বাইরে চলে গেল। হারেসের পিতা তার ঘোড়া আস্তাবল থেকে এনে দিলেন। মধ্যরাতে ডিপুটিও বেরিয়ে গেল। একাকী সাইফুদ্দীন ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের প্রায় শেষ প্রহরে হঠাৎ করে বিকট আওয়াজে দরজা খোলার শব্দে জেগে উঠল সাইফুদ্দীন। আঁতকে উঠল সে। ফৌজী পরম আনন্দে তাকে জানাল তার ভাই ফিরেছে। ফৌজী খুশীতে সাইফুদ্দীনের হাত ধরে বলল, আমার ভাইয়া এসে পড়েছে। তার সাথে এক বন্ধুও এসেছে।
তুমি কি আমার কথা তাকে বলেছো? জিজ্ঞেস করল সাইফুদ্দীন।
হ্যাঁ। বলবো না? সে তো আপনার কথা শুনে ভীষণ খুশী হয়েছে। সে আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি চাচ্ছে।
তাদের নিয়ে এসো।
* * *
দাউদ ও হারেস সাইফুদ্দীনের কামরায় ঢুকল। ফৌজী তাদের অভিবাদন জানাল। সাইফুদ্দীনের ইঙ্গিতে তারা বসল। সাইফুদ্দীনের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য জামা কাপড়ে ধুলোবালি মেখে নিয়েছিল এবং তারা এভাবে শ্বাস নিচ্ছিল যে, তারা উভয়েই খুব ক্লান্ত। সাইফুদ্দীন তাদের জিজ্ঞেস করল, মৌসুল বাহিনীর কোন ডিভিশনে ছিল তারা এবং এতদিন কোথায় ছিল, এখন কোত্থেকে এসেছে।
হারেস যেহেতু সাইফুদ্দীনের সেনা বাহিনীরই লোক তাই সে সব ঠিক মতো জবাব দিল। দাউদের কিছুই জানা ছিল না। তাই সে বেশী ক্লান্ত ভাব ধরে নীরব রইল।
দাউদ বলল, বলতে লজ্জা লাগে, আমাদের বাহিনী কি লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করেছে। আমাদেরও পলায়ন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কিন্তু ওকে নিয়ে আমি একটি টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলাম। আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বাহিনী আমাদের পশ্চাদ্বাবন করে, না-কি ওখানে শিবির স্থাপন করে। আমার খুব কৌতূহল হলো এ ব্যাপারটা জানার জন্যে। আপনার মনে হয় স্মরণ আছে, একবার খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শে আপনি একদল সৈন্যকে বিশেষ ট্রেনিং-এর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যারা গুপ্তচর ও ঝটিকা আক্রমণের ট্রেনিং নিয়েছিল। আমিও সেই ট্রেনিং-এ একজন ছিলাম। খুব ভালো করেছিলাম ট্রেনিং-এ। সে ট্রেনিং এবার আমার কাজে লেগেছে। আমি চিন্তা করলাম, পালিয়ে গেলেও আমার বাহিনীর জন্যে শত্রুপক্ষের কিছুটা হলেও খবর নিয়ে যাব আমি। তখন হারেসকে পেয়ে গেলাম আমি। তাকে বললাম, আমার সঙ্গে থাকতে। সেও থাকতে রাজী হল। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যরা আরো অগ্রসর হতে লাগল। আমার সাথে আর যদি মাত্র দশজন সৈন্য থাকতো, তাহলে গুপ্ত হামলা করে আমি ওদের বহু ক্ষতি সাধন করতে পারতাম।
আমরা দেখে এসেছি, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যরা তুর্কমান এলাকায় শিবির স্থাপন করেছে। আইয়ূবীর সৈন্যরা যেভাবে তাঁবু গেড়েছে তা থেকে বুঝা যায়, দীর্ঘ সময় তারা এ অঞ্চলে থাকবে। আফসোস! আমাদের সৈন্যরা পালিয়ে এসেছে। না হয়তো ওর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন! শত্রু বাহিনীর যে পরিমাণ মৃতদেহ আমরা দেখেছি এর সংখ্যা কয়েকশ নয় কয়েক হাজার হবে। আহত ও জখমীও অসংখ্য। রাতের অন্ধকারে আমরা ওদের তাঁবুর একেবারে কাছে গিয়ে দেখেছি, আহতের সংখ্যা যে কতো তা নিরূপণ করা কঠিন। গোটা তাঁবুতেই আহতদের চিৎকার। উহ্! আহ! এদের আর্তচিৎকারে ওখানে দাঁড়ানোই কষ্টকর। আমার তো মনে হয় ওদের অর্ধেক সৈন্যই আহত হয়ে গেছে।