মানুষ যখন স্বপ্ন আর আকাক্ষার পূজারীতে পরিণত হয় তখন কর্তব্য অবহেলিত হয়ে পড়ে। এ পথে জীবন ত্যাগের আগে আবেগকে কুরবানী করতে হয়। এ পথে অগ্রসর হতে হলে তোমাকেও আবেগকে কুরবান করতে হবে ফৌজী।
ফৌজী দাউদের গা ঘেঁষে বলল, দয়া করে আমাকেও কি তোমার সাথে নেবে দাউদ ভাই!
না।
কিছুদিন কি তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারবে না?
যদি প্রয়োজন মনে হয় তবে থাকতে পারি। বলল দাউদ। আমাকে তোমার কাছে রেখে কি করবে ফৌজী?
তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। যেদিন থেকে তুমি এসেছো, আর আমি তোমার কথা শুনেছি। এমন সুন্দর কথা জীবনে আর কখনও শুনিনি। আমার মন চায় বাকী জীবন তোমার সাথে থাকতে…।
আমার পায়ে শিকল দিও না ফৌজী! নিজেকেও আবেগের শিকলমুক্ত রাখ। সামনে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। অবশ্য পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের দরকার হবে। আমরা এক সাথে থাকবো বটে কিন্তু একজন অপরজনকে মায়ার বাঁধনে বাঁধবো না।… কিছুক্ষণ নীরব থেকে দাউদ বলল, ফৌজী! তুমি বেশী সময় আমার সঙ্গী হতে পারবে না। তোমার সম্ভ্রম আমার কাছে পবিত্র আমানত। যে কাজ পুরুষের সেটি পুরুষকেই করতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফৌজী উদাস হয়ে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কী যেন খুঁজে ফিরল দাউদের মধ্যে। ঘরে ফিরে যেতে উদ্যত হল সে। এ সময় দাউদ হাত বাড়িয়ে ফৌজীর বাজু টেনে ধরল। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফৌজী দাউদের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। দাউদ তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। ফৌজী আবেগে কম্পমান কণ্ঠে বলল, পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে। আমার সম্ভ্রম এমন কোন ঠুনকো কাগজের টুকরো নয় যে, আগুনের ধোঁয়ায় পুড়ে যাবে। আমি তোমাকে আমার সম্ভ্রম অর্পণ করতে আসিনি। তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমার কথা আমাকে নতুন জীবনের দিশা দিয়েছে। যে পথ তুমি আমাকে দেখিয়েছ সেটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি তোমার সান্নিধ্যে এজন্য এসেছি যে, এতে হয়তো তুমি তোমার বোনের পরশ পাবে। তুমি তো ক্লান্ত, তাই না দাউদ ভাই? আমাকে ভাবি বলেছে–পুরুষ যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে তখন নারী সান্নিধ্য ছাড়া পুরুষের ক্লান্তি আর কোন কিছু দূর করতে পারে না। নারী না থাকলে পুরুষের পৌরুষ থাকে না। জীবনীশক্তি মরে যায়। আমি তোমার প্রাণকে বাঁচাতে চাই, তোমাকে সাহসী ও উজ্জীবিত রাখতে চাই। তুমি যদি নিষ্প্রাণ হয়ে যাও, তাহলে কি হবে দাউদ?
দাউদ হেসে ফেলল। ফৌজীর থুতনীতে চিমটি কেটে বলল, সত্যিই ফৌজী তোমার আন্তরিক মমতা, অকৃত্রিম কথাগুলো আমার প্রাণকে সজীব করে দিয়েছে।
আমার কোন কথা তোমাকে কষ্ট দেয়নি তো? আমার ভাইকে তো বলে দেবে না যে, আমি একাকী তোমার কাছে আস্তাবলে এসেছিলাম?
না। তোমার ভাইকে কখনো তোমার এখানে আসার কথা বলব না। আর তোমার কোন কথাই আমাকে কষ্ট দেয়নি।
মনে হয় তোমার আর আমার পথ একই পথ, দাউদ ভাই! আমি অশিক্ষিত। মনের সব কথা বলতেও জানি না।
মনের কথা তুমি বলে ফেলেছ ফৌজী। তুমি ঠিকই বলেছ, আমার আর তোমার পথ অভিন্ন। আমি ঠিকই তোমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছি। তবে একথা ভুলে যেও না। আমাদের গমন পথে বিশাল রক্ত ফোরাত। যেখানে কোন সেতু নেই, পুল নেই। তুমি যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে পেতে চাও, তবে আমাদের পরিণয় লেখা হবে রক্ত দিয়ে। আল্লাহর পথের সৈনিকদের শাদী আসমানে হয়ে থাকে, আর আসমানের পথে পথে তাদের মিলন হয়। আকাশের তারকারাজী তাদের শাদীতে আলোকসজ্জা করে।
ঘরে ফিরে এল ফৌজী। অজানা পথে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল দাউদ। ফৌজী ফিরে এলো মনে একরাশ সুখানুভূতি নিয়ে। তার ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভা, আর হৃদয়ের গহীনে একটা কিছু করার কঠিন সংকল্প।
পলাতক সাইফুদ্দীন এর পয়গাম নিয়ে মালিক আস্-সালেহ এর কাছে যে কমান্ডার গিয়েছিল সে একদিন পর ফিরে এল। কমান্ডার মালিকের সাক্ষাৎ পায়নি। তবে সাইফুদ্দীনের পয়গাম তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সাইফুদ্দীন পয়গামে বলেছিল, তাকে যেন লিখিত জবাব দেয়া হয়।
কমান্ডার মালিককে বলে এল সাইফুদ্দীন কোথায় লুকিয়ে রয়েছে এবং সেই বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার পথের দিক নির্দেশনাও সে বলে এলো।
কিন্তু তিন চার দিন পর্যন্ত মালিক আস্-সালেহ এর পক্ষ থেকে সাইফুদ্দীনের কাছে কোন প্রতিউত্তর এলো না। চতুর্থ দিনে সাইফুদ্দীন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।
আমারই এখন আলেপ্পো পৌঁছানো উচিত। ডিপুটিকে বলল সাইফুদ্দীন। আলেপ্পোয় সৈন্যরা যদি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সাথে মৈত্রী করে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চক্রান্ত করে তবে আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হবে। হিরনের গভর্নর গোমশতগীনের উপর নির্ভর করা যায় না। সে যে ধরনের ধূর্ত লোক, কোন সময় কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। প্রয়োজনে খ্রিস্টানদের সাথে নিয়ে আমাদের টিকে থাকার কথা ভাবতে হবে। কারণ শুধু আমাদের একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয়।
এও তো হতে পারে যে, মালিক আস্-সালেহ এর সন্ধি প্রস্তাবই আসল কৌশল মাত্র। তিনি যে কোন সময় মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গওতো করতে পারেন। বলল ডিপুটি।
এটা খুব সম্ভব। বলল কমান্ডার। আমাকে মালিকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছে, মালিক সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এটা না হলেও সেনা কর্মকর্তারা বেশী দিন মৈত্রী টিকে থাকতে দিবে না। তাদের খ্রিস্টান উপদেষ্টারাতো এক্ষুণি আক্রমণের পরামর্শ দিচ্ছে।