শুধু আমাদের বাহিনী আক্রমণের জন্যে যথেষ্ট হবে না। মালিক ও গোমতগীনের সৈন্যদেরও আমাদের সাথে একত্রিত করতে হবে। বলল ডিপুটি।
আমি কোথায় অবস্থান করছি, একথা কি তুমি সৈন্যদের বলেছো?
আপনি এখানে লুকিয়ে রয়েছেন একথা আমি বলিনি। আমি মিত্রদের এবং আমাদের সৈন্যদেরকে বলেছি, গভর্নর তুরকমান এলাকায় ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তৎপরতা নিজ চোখে দেখার চেষ্টা করছেন। যাতে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়নে সুবিধা হয়। আমার মনে হয় আর তিন চার দিনের মধ্যে আপনার মৌসুল পৌঁছা উচিত। বলল ডিপুটি।
মৌসুল যাওয়ার আগে আমাকে আলেপ্পোর সংবাদ নিতে হবে। আশা করি কমান্ডার আগামীকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে। তুমি কি জানো, গোমশতগীন শয়তানের মতো ধূর্ত। সে তো তার কেল্লা হিরনে যাওয়ার কথা। ওখানে না গিয়ে সে আলেপ্পোতে কি করছে? মৌসুল যাওয়ার আগে আমাকে আলেপ্পো যেতে হবে। গোমশতগীন আমাদের মিত্র বটে কিন্তু তাকে আমি কখনও বন্ধু মনে করি। মালিক আস্-সালেহ-এর কমান্ডারদেরকে সম্মত করাতে হবে যে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর প্রস্তুতির সুযোগে তারা যেন পুনর্বার আক্রমণে আমাদের সহযোগিতা করে। তাদের একথাও বোঝাতে চেষ্টা করব যে, তিন বাহিনীর যৌথ কমান্ডের বদলে একক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করা উচিত। আর কমান্ড আমার হাতে আনার চেষ্টা করব। তাদের বোঝাতে হবে, বিগত যুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন কমান্ড হওয়ার কারণে আমরা একে অন্যের কৌশল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম; যার ফলে আমাদের পরাজিত হতে হয়েছে। তা না হলে মুজাফফর উদ্দীন, আইয়ূবী বাহিনীর উপর যে তীব্র আক্রমণ করেছিল তা কখনও ব্যর্থ হতো না।
কেন্দ্রীয় কমান্ড আপনার হাতে থাকা উচিত। বলল ডিপুটি।
মিত্রদের সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বলল সাইফুদ্দীন। আচ্ছা তুমি কি বলতে পারো, খ্রিস্টানরা কি আমাদের সহযোগিতা করবে?
ওরা সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করবে না; তবে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং উট-ঘোড়া দিয়ে সহযোগিতা করবে। মহামান্য গভর্নর! আপনি এখানে কোনরূপ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন না তো? জিজ্ঞেস করলো ডিপুটি।
না। বুড়োকে বিশ্বস্তই মনে হয়। আর ওই মেয়েটিও আমার জালে ধরা দিয়েছে। তবে মেয়েটি খুব আবেগ প্রবণ। বলে কি জানো! আপনি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে, তার তরবারী হাতে নিয়ে, তার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসেন, তাহলে আমি আপনার সাথে চলে যাবো।
সাইফুদ্দীনের কথা শুনে ডিপুটি অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল। বৃদ্ধ ও দাউদ দেয়ালে কান লাগিয়ে ওদের সব কথাই শুনছিল। সাইফুদ্দীন ও তার ডিপুটি মোটেও জানে না যে, বৃদ্ধের ঘরে বুড়ো ও দুটি মেয়ে ছাড়া আরো দুজন যুবকও রয়েছে যারা সুযোগ পেলে সাইফুদ্দীনকে হত্যাও করতে পারে। সাইফুদ্দীন ঘুর্ণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি, সে ফৌজীকে তার ফাঁদে আটকায়নি বরং সে নিজেই ফৌজীর পাতা জালে আটকে গেছে।
* * *
দাউদ ও হারেস ঘরের ভিতরেই অবস্থান করল। পরদিন ফৌজী কয়েকবার গেল সাইফুদ্দীনের ঘরে। ফৌজী সাইফুদ্দীন থেকে নিরাপদ দূরে দূরে থেকে কথা বলত। ফৌজীর দূরত্ব বজায় রাখার কারণে নারী লিন্দু সাইফুদ্দীন ফৌজীকে বাহুবদ্ধ করতে, ওকে কাছে টানতে উদগ্রীব হয়ে পড়ল। ফৌজীকে আকৃষ্ট করতে সে বলল, তোমার ভাই আমার সেনাবাহিনীতে একজন সাধারণ সৈনিক মাত্র, এবার তাকে আমি কমান্ডার বানিয়ে দেব।
আমরা তো এটাই জানি না যে, ভাই জীবিত আছে না মারা গেছে। সে মারা গেলে আমরা খুবই অসহায় হয়ে যাবো। বলল ফৌজী।
ফৌজীর বৃদ্ধ পিতাও দিনের বেলায় সাইফুদ্দীনের থাকার ঘরে কয়েকবার গিয়ে তাদের সেবাযত্নের খোঁজ খবর নিলেন। কোন কিছুর প্রয়োজন, অসুখ-অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাইলেন অতি বিনয়ের সাথে। তিনি সাইফুদ্দীনকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, প্রথম রাতে কিছুটা বিরূপ কথা বললেও সাইফুদ্দীনের প্রতি বিশ্বস্ত তিনি।
রাতে আবার সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বৃদ্ধ দরজা খুললেন। সাইফুদ্দীনের কমান্ডার আলেপ্পো থেকে ফিরে এলো। বৃদ্ধ কমান্ডারকে সাইফুদ্দীনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আস্তাবলে ঘোড়া বেঁধে কমান্ডারের খাবারের আয়োজন করতে হবে কি-না জানতে গেলেন। কমান্ডার ছিল ক্ষুধার্ত, পথিমধ্যে সে কোথাও বিশ্রাম-আহারের ফুরসত পায়নি। বৃদ্ধ কমান্ডারের জন্যে খাবার আনতে ঘরে গেলে ফৌজী আবদার করল, সে নিজে খাবার নিয়ে যাবে, যাতে তাদের কথাবার্তা শুনতে পায়।
ফৌজী খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই কমান্ডার কথা বলা বন্ধ করে দিল। সাইফুদ্দীন বলল, বল, ও আমাদেরই মেয়ে। ফৌজী কমান্ডারের সামনে খাবার রেখে সাইফুদ্দীনের সামনে গিয়ে বসল। অন্যদিনের চেয়ে ফৌজী একটু কাছে বসল সাইফুদ্দীনের। সাইফুদ্দীন ফৌজীর হাত নিজের হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ফৌজী অনুভব করল এ মুহূর্তে সাইফুদ্দীনের হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলে সে অপমানবোধ করে তার প্রতি বিরাগ হবে এবং ওর কাছ থেকে আর কোন গোপন কথা বের করা সম্ভব হবে না। তাই বৃহত্তম স্বার্থে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নেয়া থেকে বিরত রইল। কান পেতে থাকল ওদের কথা শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
আলেপ্পোর সৈন্যরা এখনও যথেষ্ট উজ্জীবিত। বলে কথা পুনরায় শুরু করল কমান্ডার। ফৌজী সাইফুদ্দীনের আঙ্গুল থেকে হিরের আংটি খুলে নিয়ে নিজের আঙ্গুলে পুরে হিরেটিকে শিশুদের মতো বিস্ময়ভরে দেখতে লাগল। ভাবটা এমন যে কমান্ডারের কথার প্রতি তার মোটেও কোন আগ্রহ নেই। অথচ সে উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে কমান্ডারের কথার প্রতি।