আমাকে কি আপনার সাথে যুদ্ধে নিয়ে যাবেন? অতি সরল কণ্ঠে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল কিশোরী।
না, তা হতে পারে না। বলল সাইফুদ্দীন। আগে আমার সৈন্যদের সংগঠিত করতে হবে। এক কমান্ডারকে আমি মৌসুল পাঠিয়েছি। তাকে আমি বলে দিয়েছি বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের একত্রিত করে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি নিতে। যাতে সে আমাদের শহরগুলোকে ঘেরাও করতে না পারে। আজ সন্ধ্যার মধ্যে উভয়েই ফিরে আসলে জানা যাবে আলেপ্পো ও হিরনের সৈনিকদের অবস্থা ও পরিস্থিতি কি? আমরা পরাজয়কে মেনে নিচ্ছি না। শীঘ্রই প্রতিআক্রমণ করব, অবশ্যই করব।
সাইফুদ্দীনের ব্যক্তিত্ব ছিল এমনি। ক্ষমতা ও নারী লিপ্সা তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সে এক সরলা গেঁয়ো মেয়ের কৌশলের কাছে নিজের রণকৌশল প্রকাশ করে দিল। সাইফুদ্দীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আত্মস্থ করার পর কিশোরী তাকে অভিবাদন জানিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল।
সাইফুদ্দীনের সাথে যে দুজন সৈনিক এসেছিল এদের একজন মৌসুল আর অপরজনকে আলেপ্পো পাঠিয়েছে। হারেসের বোন পিতা, ভাই ও দাউদকে বলল, তার চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের কথা। সে আরো বলল, গভর্নর চাচ্ছে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী যাতে তাদের শহর ঘেরাও করতে না পারেন এজন্য তিন বাহিনীকে আবার একত্রিত করে সালাহ উদ্দীনের উপর আক্রমণ করবে। যে দুজনকে সে পাঠিয়েছে এরা ওখানকার সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধ করার মতো সাহস রাখে কি-না তা জানার জন্যে গিয়েছে। সাইফুদ্দীন হারেসের বোনকে যা বলেছিল তা সে পিতা, ভাই ও দাউদকে বলল।
এতক্ষণ আমরা যে মেয়েটির কথা বললাম, সেই কিশোরী মেয়েটির নাম ফৌজী। ফৌজী বেদুঈন মেয়ে। লেখাপড়া তেমন নেই। কুরআন শরীফ ও আনুসঙ্গিক সামান্য কিছু পড়া লেখা করেছে মাত্র। তেমন চালাক চতুরও নয়। কিন্তু একটা ন্যায়নিষ্ঠা পারিবারিক ঐতিহ্য ও আরব বেদুঈন হিসেবে লালন করে ফৌজী। ইসলামী চেতনা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চতুর না হলেও সচেতন। দাউদ তাকে কিছুটা কৌশলী হওয়ার তালীম দিল। বলল, সাইফুদ্দীন দীন ও ইসলামের দুশমন। সে ক্ষমতার লোভে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর জিহাদকে বেঈমান বিধর্মীদের সহায়তায় নস্যাৎ করে দিতে তৎপর। সে জাতির ঘোরতর শত্রু। জাতীয় স্বার্থে তুমি কিছুটা অভিনয় করে ওর মনের খবর নিতে চেষ্টা করবে। তবে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে। ও খুবই ধূর্ত এবং নারী লিন্দু। নিজের মান-সম্ভ্রমের প্রতি খেয়াল রেখো। কখনও ওর দেয়া লোভে ভুলে যেও না নিজের আদর্শ।
ফৌজী ধারণার চেয়েও বেশী কৌশলে সাইফুদ্দীনের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা কথা বের করে এনেছে। দাউদ ভাবতেও পারেনি এই বেদুঈন মেয়েটি এতোটা দক্ষতার সাথে পাকা গোয়েন্দার মতো কাজ করতে পারবে। ফৌজীর কাছে সাইফুদ্দীনের পরিকল্পনা জানার পর দাউদ সিদ্ধান্ত নিল, কুচক্রীদের চক্রান্ত ভণ্ডুল করতে হলে সাইফুদ্দীনের অনুসরণ করার বিকল্প নেই। ওর তৎপরতা জানতে হবে এবং সে কোথায় কি করতে যাচ্ছে এসব বুঝতে হবে।
প্রায় মাঝ রাতে বৃদ্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি শুনতে পেলেন বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। অশ্বের হেষারবও শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ বিছানা ছেড়ে দরজা খুললেন। বাইরে সাইফুদ্দীনের ডিপুটি দাঁড়িয়ে।
বৃদ্ধ তার ঘোড়া বেঁধে রাখার জন্যে আস্তাবলের দিকে পা বাড়ালেন। ডিপুটি গেট পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল, যে ঘরে সাইফুদ্দীন ঘুমিয়ে ছিল। ঘোড়া বেঁধে রেখে ফিরে এসে ডিপুটিকে খাবারের আবেদন করলেন বৃদ্ধ। ডিপুটি খাবার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাল। বৃদ্ধ দাসের মতো বিনয় নম্রভাবে তাকে আবারো খানার জন্যে অনুরোধ করলেন কিন্তু ডিপুটি তার অনুরোধে পাত্তা দিল না। সাইফুদ্দীন বৃদ্ধকে বলল, তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ওর খাবারের প্রয়োজন নেই। বৃদ্ধ একজন নগণ্য প্রজার মতো খুবই কাচুমাচু করে তাদের অভিবাদন জানিয়ে কামরা ত্যাগ করলেন। ঘরে এসে তিনি দাউদকে জাগিয়ে সাইফুদ্দীনের ডিপুটির আগমন বার্তা জানালেন। দাউদ বৃদ্ধকে নিয়ে সাইফুদ্দীনের ঘরের দেয়ালে কান লাগিলে ওদের কথাবার্তা শোনার জন্য ওঁৎ পেতে রইল।
গোমশতগীন এখন মালিক আস-সালেহ এর আশ্রয়ে আলেপ্পোয় রয়েছে বলে জানা গেছে। বলল সাইফুদ্দীনের ডিপুটি। মৌসুলে আমি যে পরিস্থিতি দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধের উপযুক্ত। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী তুর্কমানে অবস্থান করছে। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা বলেছে, সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আলজেরিয়া, দিয়ার ও বকরা ইত্যাদি এলাকা থেকে তার বাহিনীতে লোক ভর্তি করছে। তার তৎপরতা থেকে মনে হচ্ছে, খুব শীঘ্রই সে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আরো অগ্রসর হবে হয়তো তবে বিগত দিনের মরু ঝড়ে তার তাঁবু ও রসদপত্র বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এসব না গুছিয়ে হয়তো সে আর অগ্রসর হবে না। তাছাড়া সে হয়তো ভাবছে, আমাদের সৈন্যদের হয়তো যুদ্ধ করার মতো অবস্থা নেই। মৌসুলে আমাদের সেনাবাহিনীর যেসব সৈন্য ফিরে এসেছে সংখ্যায় এরা এক তৃতীয়াংশেরও কম হবে। অধিকাংশ সৈন্যই মারা গেছে, নয়তো হারিয়ে গেছে।
এতো অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর উপর আবার হামলা করা কি সম্ভব? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল সাইফুদ্দীন।