তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে ধোকা দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করাচ্ছে একে আমি এখানেই হত্যা করে ফেলি? বলল হারেস।
সময় হলে আমি তোমাকে বলব, বলল দাউদ। কোন কোন সময় হত্যা না করাও উপকারী। তোমাকে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। সাইফুদ্দীনের প্রতি আমাদের গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তার পশ্চাদ্ভাবন করতে হবে। সাইফুদ্দীন যেভাবে এখানে লুকিয়ে রয়েছে আমি এবং হারেসও তার দৃষ্টির আড়ালে থাকব এবং তার যাবতীয় তৎপরতা প্রত্যক্ষ করব।
* * *
সাইফুদ্দীন এই বাড়ির একটি ঘরে গভীর ঘুমে অচেতন। ভোর বেলায় বৃদ্ধ উঁকি দিয়ে দেখল, সে তখনো ঘুমাচ্ছে। বেলা অনেক হওয়ার পর তার ঘুম ভাঙ্গলো। হারেসের বোন ও স্ত্রী তার জন্য নাস্তা নিয়ে এল। সাইফুদ্দীন হারেসের বোনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা আমার যে সেবা করছ এর পরিবর্তে এমন পুরস্কার তোমাদের দেব যা তোমরা কল্পনাও করতে পার না। তোমাকে আমি আমার শাহী মহলে রাখব।
আপনাকে যদি আমরা এই কুঁড়ে ঘরেই রেখে দেই তাহলে কি আপনি নারাজ হবেন, অসন্তুষ্ট হবেন? স্মিত হেসে বলল কিশোরী।
আমরা তো মরুভূমিতেও থাকতে পারি। বলল সাইফুদ্দীন। কিন্তু তোমরা তো ফুলের মতো সাজিয়ে রাখার জিনিস।
আপনি কি মনে করেন যে, শাহী মহলে আবার ফিরে যেতে পারবেন? বলল কিশোরী।
তুমি এ কথা বলছ কেন?
আপনার অবস্থা দেখে। বলল কিশোরী।
কুঁড়ে ঘরে লুকিয়ে থাকাই প্রমাণ করে বাদশাহর রাজত্ব হাত ছাড়া হয়ে গেছে এবং তার সৈন্যসামন্ত তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
সৈন্যরা আমাকে ছেড়ে যায়নি, বলল সাইফুদ্দীন। আমি একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য এখানে এসেছি। রাজমহলে ফিরে যাওয়া শুধু আমার ভাগ্যে নয়, তোমার ভাগ্যেও লেখা হয়ে গেছে। তুমি কি আমার সাথে যাওয়া পছন্দ কর না?
হারেসের স্ত্রী কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিশোরী সাইফুদ্দীনের অদূরে বসে গেল এবং বলল, যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম তাহলে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত না করে ঘরে ফেরার নাম নিতাম না। যদি আপনি আমাকে পছন্দ করে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি আপনার এই পালিয়ে আসা এবং লুকিয়ে থাকা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। যুদ্ধ কৌশলী শাসকদের মত আপনি ময়দানে বেরিয়ে যান, বিচ্ছিন্ন সৈনিকদেরকে একত্রিত করুন এবং সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর উপর আক্রমণ করুন।
কিশোরীটি ছিল একেবারেই সাদাসিদে। তার বক্তব্যে কোন প্রতারণা ছিল না। সাইফুদ্দীন তাকে খুব তন্ময় হয়ে দেখছিল এবং তার ঠোঁটে খেলা করছিল পৈশাচিক হাসি ও পাশবিক লিপ্সা।
আমি তো শাহাজাদী নই, বলল কিশোরী। এই মরুভূমি এবং উপত্যকাতেই জন্ম নিয়েছি, এখানেই বেড়ে উঠেছি। আমি সৈনিকের মেয়ে এবং সৈনিকের বোন। আপনার সাথে রাজপ্রাসাদে নয় রণাঙ্গনে যেতে আমি প্রস্তুত। আপনার সাথে আমি তরবারি নিয়ে খেলা করব। আমাকে পেতে হলে মরুভূমিতে, পাহাড়ের ঢালে, টিলার উপরে আপনাকে ঘোড়া ছুটাতে হবে।
তুমি শুধু সুন্দরীই নও, লড়াকুও বটে। সাইফুদ্দীন তার চুল হাতে নিয়ে বলল, এত সুন্দর রেশমী চুল জীবনে আর কখনো দেখিনি।
কিশোরী সলজ্জ বিনয়ে সাইফুদ্দীনের হাতটি সরিয়ে দিল এবং বলল, রেশমী চুল নয় এ মুহূর্তে আপনার দরকার আমার বাহু, আমার শক্তি। আপনি আমাকে বলুন তো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
তোমার বাবা একজন বিপজ্জনক লোক। বলল সাইফুদ্দীন। মনে হয় সে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সহযোগী। আমাকে হয়ত অপছন্দ করে। আমার ভয় হয় সে আমাকে আবার থোকা না দেয়।
খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল কিশোরী। বলল, তিনি বুড়ো মানুষ। জানি না আপনার সাথে কি কথা বলেছেন। তিনি রাত থেকেই আমাদের কাছে আপনার প্রশংসা করছেন। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর নাম শুনেছেন মাত্র। তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এজন্য আপনি ভয় করবেন না। বৃদ্ধ মানুষ আর আপনার কি ক্ষতি করতে পারবেন? আমাকে পরীক্ষা করুন।
সাইফুদ্দীন কিশোরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিশোরী দূরে সরে গিয়ে বলল, আপনার সব আশা পূর্ণ হবে। আপনি আমাকে পেতে পারেন তবে এর জন্য আপনাকে শর্ত পালন করতে হবে। তখনি আপনি আমাকে পাবেন যখন সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীকে পরাজিত করে ফিরে আসবেন। আপনি এখন সঙ্কটে রয়েছেন, এ মুহূর্তে…। আচ্ছা আপনি আমাকে বলুন তো, ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?
সাইফুদ্দীন ছিল আরামপ্রিয়, বিলাসী, ভোগবাদী ও নারীলিন্দু। সুন্দরী যুবতী নারী তার জন্য মোটেও দুর্লভ ছিল না। কিন্তু এই পল্লীর সরলা মায়াবী মেয়েটির নির্মল অভিব্যক্তি ও বুদ্ধিমত্তা তাকে বিমোহিত করে ফেলেছে। সবচেয়ে আকর্ষণের ব্যাপারটি এই ছিল যে, মেয়েটি তার আকাঙ্ক্ষাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। অথচ এর চেয়েও সুন্দরী, অভিজাত যুবতী মাত্রই তার ঈশারায় নাচতে শুরু করে। বস্তুত এই অবলা মেয়েটি তার পৌরুষকে এইভাবে আঘাত করেছিল যে, তার আভিজাত্য ও অহংবোধে মারাত্মক ঘা লেগেছিল।
শোন মেয়ে! বলল সাইফুদ্দীন। তুমি আমার পৌরুষের পরীক্ষা নিতে চাও। ঠিক আছে, সেইদিনই তোমাকে আমি তুলে নেব যেদিন সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর তরবারী আমার মুষ্ঠিবদ্ধ থাকবে। আইয়ূবীর ঘোড়ায় আমি সওয়ার থাকব। আমাকে কথা দাও, সেদিন তুমি আমার কাছে আসবে তো?